Friday 19th of April 2024
Home / পরিবেশ ও জলবায়ু / ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত বহুগ্রাম

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত বহুগ্রাম

Published at মে ২৬, ২০২১

ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা) : ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে খুলনার কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা উপকূলে বাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। প্লাবিত হয়েছে বহুগ্রাম। লবনপানি প্রবেশ করায় লোকালয়, ফসলি জমি ও মৎস্য ঘের হুমকির মধ্যে পড়েছে। ভরা পুর্ণিমায় ইয়াসের প্রভাবে  খুলনার কয়রা উপজেলার কপোতাক্ষ-শাকবাড়িয়া নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে ভেঙে গেছে বেড়িবাঁধ। এতে প্লাবিত হয়েছে  অন্তত ৪০টি গ্রাম। ফলে আতঙ্কে রয়েছেন ভাঙনকবলিত এলাকার বাসিন্দারা।

বুধবার (২৬ মে) ভোর থেকে কয়রা উপকূলে থেমে থেমে হালকা বৃষ্টি শুরু হয়। সকাল ৮টার পরপরই সূর্যের দেখা মেলে। এরপর কখনো গুড়ি গুড়ি আবার কখনো ঝড়ো বৃষ্টি। ফের রোদ। এভাবেই রোদ-বৃষ্টির খেলা চলে। এরপরই ঝড়ো বাতাস ও বৃষ্টি শুরু হয়। বেলা ১১ টার পর থেকে জোয়ারের পানি বাড়তে শুরু করে। উত্তাল ঢেউ এসে আঘাত করে দূর্বল বেড়িবাঁধে। প্রথম পর্যায়ে বাঁধ উপচে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করতে শুরু করে। পরবর্তীতে নদী উত্তাল হয়ে উঠলে বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। সেখান থেকে লোকালয়ে নদীর নোনা পানি প্রবেশ করে। প্লাবিত হয় বহু গ্রাম।

মহারাজপুর ইউনিয়নের দশহালিয়া গ্রামের আসমা বেগম বলেন, ঝড় আসলে বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি বাড়িতে প্রবেশের আতেঙ্কে থাকতে হয়। আম্পানেও ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছিলো। আজও বাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানিতে ঘর প্লাবিত হয়েছে। লঞ্চঘাট এলাকার আনোয়ারা বেগম বলেন, ঝড়ে বেশ কয়েক দফা ঘর ভেঙেছে। আম্পানেও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি। এবারও আতঙ্ক বিরাজ করছে।

স্থানীয়রা জানান, জোয়ারের পানিতে বাড়ির আঙিনা, রাস্তা-ঘাট, মাছের ঘের ও ফসলের মাঠ তলিয়ে গেছে। উপজেলার আংটিহারা, মঠবাড়ি, গোবরা ঘাটাখালী, কয়রা সদরের তহশিল অফিস সংলগ্ন বেড়িবাঁধ, দশহালিয়া, কাটকাটা, কাশির হাটখোলা, কাটমারচর, ২ নম্বর কয়রা, ৪নম্বর কয়রা, পবনা, তেঁতুল তোলার চর, কাশির খালের গোড়া, হোগলা, উত্তর বেদকাশি, গাতির ঘেরী, শাকবাড়িয়া, সুতির অফিস, নয়ানি, খোড়ল কাটি, জোড়শিংসহ বিভিন্ন এলাকায় বেড়িবাঁধ উপচে পানি প্রবেশ করে। এতে কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদী তীরবর্তী ৪০টির বেশি গ্রামে পানি প্রবেশ করছে। দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের (বাঁধ ভাঙন) বাসিন্দা আবু সাইদ খান বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসলে আমারা খুবই আতঙ্কে থাকি। বিশেষ করে রাতে। এলাকার মানুষ ছেলে-মেয়ে নিয়ে বসে থাকেন। কখন বাড়ি-ঘর ভেঙে নদীতে চলে যায়।

কলেজ ছাত্র মহসিন জানান, মহারাজপুর ইউনিয়নের পবনা ভেঙে এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানির চাপে প্রতিদিন নদী ভাঙছে। আজ বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে আমাদের এলাকা তলিয়ে যাচ্ছে। রাতে পানি আরও বাড়বে। আমারা সবাই আতঙ্কে আছি। তাই দ্রুত এ বাঁধটি মেরামতের জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি দাবি জানাই। উত্তর বেদকাশী ইউপি চেয়ারম্যান সরদার নূরুল ইসলাম  বলেন, মঙ্গলবার রাতে জোয়ারে ইউনিয়নের কয়েকটি স্থানে বেড়িবাঁধ উপচে পানি প্রবেশ করে। আজ (বুধবার) বুধবার দুপুরে শাকবাড়িয়া নদীতে অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বেশ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়।

পাইকগাছা ইউএনও এবিএম খালিদ হোসেন সিদ্দিকী বলেন, বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। সোলাদানা, গড়ইখালী, রাড়ুলী, কোপিলমুনি, লতা, দেলুটি এই ছয়টি ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে বাঁধ উপচে প্লাবিত হয়েছে লোকালয়। অনেক স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। অনেকেই আশ্রয় কেন্দ্রে রাত থেকে রয়েছে। তাদের খাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বেড়িবাঁধ মেরামতে আমাদের কর্মী এবং এলাকাবাসী কাজ করছেন। এখনও প্লাবিত হওয়া গ্রামের সংখ্যা জানতে পারিনি। জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। দাকোপ উপজেলার কামনীবাসিয়া, পানখালী এবং মেরিন কোম্পানির আশপাশ সহ বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ উপচে ও ভেঙে লোকালয় প্লাবিত হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

কয়রা উপজেলায়  ১১ পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে। এতে ৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বুধবার (২৬ মে) দুপুরের প্রবল জোয়ারে বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ শুরু করে। এতে ডুবে গেছে মাছের ঘের ও ফসলি জমি।
কয়রার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন স্বাধীন সমাজকল্যাণ যুব সংস্থার সভাপতি মো. আবু সাঈদ খান জানান, কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের আংটিহারা এলাকার শ্রীপদ মণ্ডলের বাড়ির সামনে ১০০ মিটার বেড়িবাঁধ দুপুরের জোয়ারে বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। পূর্ণিমার প্রভাবে কপোতাক্ষ নদের পানি বেড়ে বেড়িবাঁধ উপচেও অনেক স্থানে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। এতে আংটিহারা ও খাশিটানা গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।এ নিয়ে এলাকার হাজারো মানুষ আতঙ্কে আছেন।

এছাড়া, মহারাজপুর ইউনিয়নের দশালিয়ায় কপোতাক্ষ নদের পাউবোর বেড়িবাঁধে প্রায় ১০ স্থানে ভেঙে লোনা পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে। মঠবাড়ি বেড়িবাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। দশালিয়া গ্রামের মজিবুর মাস্টারের বাড়ীর পাশে ৫০০ মিটার বাঁধ ভেঙে ৩ টি গ্রাম প্লাবিত হয়। গ্রামগুলো হলো, দশালিয়া, গোবিন্দপুর ও আটরা। মহারাজপুর গ্রামের বাসিন্দা কামাল হোসেন বলেন, দশালিয়ায় পাউবোর বেড়িবাঁধ ১০টি স্থানে প্রায় ১শ হাত জায়গায় প্রবল জোয়ারের পানিতে ভেঙে গেছে। এতে লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়েছে। ডুবে গেছে মাছের ঘের, বিশাল ফসলি জমি। এ এলাকার ৩১/৩২টি পরিবারের মধ্যে ৭/৮টি পরিবারের বসত বাড়ির মধ্যে পানি ঢুকে গেছে। শত চেষ্টা করেও বেড়িবাঁধ রক্ষা করা যায়নি।

স্থায়ীদের অভিযোগ, বার বার বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হলেও টেকসই বাঁধ নির্মাণে কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। কখনো কখনো দায়সারা কাজ হয়েছে। এলাকার জনপ্রতিনিধিরা মানুষের কষ্টের কথা কখনোই বিবেচনায় নেয়নি। যে কারণে আম্পানের এক বছর পার হতে না হতেই আবার ইয়াসের প্রভাবে পানিতে ডুবতে হচ্ছে। খুলনা আঞ্চলিক আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ মো. আমিরুল আজাদ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

কয়রা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম বাহারুল ইসলাম বলেন, গত বছরের ২০ মে আম্ফানের আঘাতে বেড়িবাঁধ ভেঙে সদর ইউনিয়ন প্লাবিত হয়। সে ক্ষতি মানুষ এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি।

সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুর রহমান বলেন, দক্ষিণ অঞ্চলের নদ-নদীতে দুই থেকে তিন ফুট পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। উপজেলার প্রায় ৩০টি পয়েন্ট দিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। তিনি আরও বলেন, আমরা ২০ হাজার জিও ব্যাগ ও ৩০ হাজার সিনটেথিক ব্যাগ মজুদ রাখা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় জিও ব্যাগ দিয়ে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের খুলনা বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোঃ আবুল হোসেন জানান,ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্থ বেড়িবাঁধ  মেরামতে আমাদের  সকল কর্মকর্তা কর্মচারী মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করছে । স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সম্মন্বয়ে পাউবো খুলনা উপকুলীয় বিভিন্ন উপজেলার ক্ষতিগ্রস্থ বিভিন্ন পয়েন্টের বেড়িবাঁধ সংস্কার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে । যেহেতু এখন ভাটা চলছে আশা করি দ্রুত ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামত সম্ভব হবে । এ ছাড়াও বেড়িবাঁধের  যেসব পয়েন্ট বেশি ঝুঁকিপূর্ণ সেই পয়েন্টগুলোতে জিও ব্যাগ দিয়ে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পাউবোর মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা কর্মচারীরা।

খুলনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব মোঃ আক্তারুজ্জামান বাবু জানিয়েছেন, তিনি তার নির্বাচনী এলাকায় থেকে ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্থ বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেছেন। উপজেলা প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিসহ দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার বাঁধ মেরামতের কাজ নিজে উপস্থিত থেকে তদারকি করছেন। এমপি জানান, গতবারের মত এবারও, যতবড় ঘুর্ণিঝড়ই আসুক না কেন তিনি এলাকার মানুষের সাথে থেকে সব কিছু করবেন। জনগনের জানমালের নিরাপত্তার জন্য যা করার দরকার তাহা তিনি করবেন।

This post has already been read 2140 times!