Thursday 28th of March 2024
Home / এক্সক্লুসিভ / “আসবে মাংস, যাবে পোশাক” প্রেক্ষিত ও বাস্তবতা

“আসবে মাংস, যাবে পোশাক” প্রেক্ষিত ও বাস্তবতা

Published at সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৯

ড. শরীফ আহম্মদ চৌধূরী : বিগত ৩১ আগস্ট ২০১৯-এ “দৈনিক প্রথম আলো” পত্রিকায় প্রকাশিত “আসবে মাংস, যাবে পোশাক” শীর্ষক প্রতিবেদনটির প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে। এ দেশে ১ কোটি ৬১ লক্ষ গবাদিপশু পালনকারী খানার প্রায় ৬ কোটি জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা বিপন্নকারী উক্ত প্রস্তাবনার সাথে আমরা দ্বিমত পোষণ করছি। জনস্বার্থে এধরনের যে কোন উদ্যোগ বাস্তবায়ন না করার জন্য আমরা বর্তমান জনবান্ধব সরকারকে অনুরোধ করছি।

বিগত কয়েক বছরে প্রাণিসম্পদ খাতে প্রভূত উন্নতি হয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে বাংলাদেশ এখন মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। জনপ্রতি দৈনিক ১২০গ্রাম মাংসের চাহিদা হিসাবে দেশে মাংসের চাহিদা বছরে মোট ৭২.৯৭ লক্ষ টন। বিগত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগী থেকে মোট মাংস উৎপাদিত হয়েছে ৭৫.১৪ লক্ষ টন,  অর্থাৎ  উদ্বৃত্ত উৎপাদন হয়েছে ২.১৭ লক্ষ টন। এরমধ্যে গরু-ছাগলের মাংস মোট মাংসের প্রায় ৫৫% ভাগ।

বাংলাদেশের প্রায় ৮০-৯০% মাংস উৎপাদিত হয় ভূমিহীন এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারী (০-২.৪৯ একর) আকারের খামারে, যা কৃষির অন্যান্য উপ-খাত বিশেষতঃ ফসল খাতের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ফসলের বিভিন্ন উপজাত যেমন: খড়, কুড়া, ভুষিই মূলত এধরনের খামারে প্রাণির প্রধান খাদ্য। আবার এসব খামারের গোবর/আবর্জনা উক্ত খামারে ফসলী জমির জৈব সারের প্রধান উৎস। এভাবে পুষ্টির পুন:চক্রায়নের মাধ্যমে এসব পরিবেশবান্ধব প্রাণির খামার দীর্ঘদিন যাবৎ এদেশে টিকে আছে। সম্প্রতি এদেশে গরু মোটাতাজাকরণে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারী আকারের বাণিজ্যিক খামার গড়ে উঠেছে যা বছরব্যাপি মোট সরবরাহের প্রায় ১০-২০% পর্যন্ত সরবরাহ করে। এসব খামারে ৫-১২জন পর্যন্ত লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। এভাবে প্রাণিসম্পদ খাত দেশের মোট জনসংখ্যার প্রত্যক্ষভাবে ২০% এবং পরোক্ষভাবে প্রায় ৫০% লোকের কর্মসংস্থান করে।

দেশে বর্তমান প্রায় ২৫৭.২৪ লক্ষ গরু/মহিষ ও ২৯৮.০০ লক্ষ ছাগল/ভেড়া রয়েছে। এ বছর কোরবানীযোগ্য গবাদিপশুর মধ্যে ৪৫.৮২ লক্ষ গরু/মহিষ এবং ৭২.০০  লক্ষ ছাগল/ভেড়া দেশে উৎপাদিত হয়েছে। বছরের অন্যান্য সময়েও মাংসের জন্য প্রায় সমপরিমাণ গরু/ছাগল উৎপাদন হয়। অর্থাৎ সারাবছর প্রায় ৯০.০০ লক্ষ গরু/মহিষ এবং ১৪০.০০ লক্ষ ছাগল/ভেড়া মাংসের জন্য খামারীগণ উৎপাদন করেন। এ পরিমাণ গরু/মহিষ ও ছাগল/ভেড়া পালনের মাধ্যমে প্রায় ৩৭.০০ লক্ষ দরিদ্র খানার বছরব্যাপী স্বকর্মসংস্থান হয়ে থাকে। এ সকল ক্ষুদ্র, মাঝারী ও বাণিজ্যিক খামার কৃষক পরিবারের আয়, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে আপদকালীন সম্পদ হিসাবে ভূমিকা রাখছে। এসব খামারীর অক্লান্ত ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় দেশ এখন মাংসে স্বয়ংসম্পূর্ণ।

তবে নিকট অতীতেও এ অবস্থা ছিল না। নব্বইয়ের দশকে এদেশে জবাইকৃত ৭০% গরু/মহিষ আসতো দেশের বাইরে থেকে। হাড়-জিরজিরে, বয়সের ভারে ন্যুজ বলদ টেনে হিঁচড়ে কসাইখানায় নেয়ার দৃশ্য এখনও আমাদের স্মৃতিতে ভেসে উঠে। বর্তমান শতাব্দীর শুরু থেকে এদেশে গরু মোটাতাজাকরণ শুরু হয়। ভারতের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে ২০১৪ সাল থেকে সীমান্ত পথে অবৈধভাবে গরুর অনুপ্রবেশ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। তখনই প্রথম বাংলাদেশের খামারীগণ পবাদিপশু পালনে লাভের মুখ দেখেন। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের ফলে এদেশে অসংখ্য ক্ষুদ্র, মাঝারী ও বাণিজ্যিক খামার গড়ে উঠেছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে এদেশে ৪,৪২,৯৯১টি নিবন্ধিত গরু মোটাতাজারণ খামার ও ৫৯,২৭৪টি ডেইরি খামার রয়েছে। তাছাড়াও সারাদেশে রয়েছে অসংখ্য অনিবন্ধিত খামার। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পারিবারিক খামারের পাশাপাশি এসব বাণিজ্যিক খামার এখন দেশের বিফ ক্যাটেল সরবরাহের প্রধান যোগানদাতা।

প্রাণিসম্পদ খাতের এই বিকাশমান ধারার বিপরীতে সম্প্রতি বেশ কিছু নেতিবাচক ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে রয়েছে তরল দুধে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক রাসায়নিক দ্রব্যের উপস্থিতি বিষয়ক প্রচারণা, কোরবানির চামড়া ক্রয়-বিক্রয় বিপর্যয় এবং সর্বশেষ  হ্রাসকৃত শুল্কে আরো অধিকহারে মাংস আমদানীর উদ্যোগ। স্বল্পমূল্যে আমদানীকৃত মাংসের ফলে দেশীয় গবাদিপশু উৎপাদনে তথা বাংলাদেশে মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে অবশ্যই ঋণাত্মক প্রভাব পড়বে। এছাড়াও জাতীয় কৃষি অর্থনীতিতে, জনগণের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায়, পরিবেশের উপর এবং সামাজিক ক্ষেত্রে এর প্রভাব হতে পারে মারাত্মক।

গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রভাব : মাংসের জন্য উৎপাদিত ৯০ লক্ষ গরু/মহিষ এবং ১৪০ লক্ষ ছাগল/ভেড়া গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রায় ৫৫.০০ হাজার কোটি টাকা সঞ্চালনে সহায়তা করে। এ সঞ্চালনের ন্যূনতম ৭০% (প্রায় ৩৮ হাজার কোটি) দরিদ্র/অতিদরিদ্র খামারীদের মাঝে হয়ে থাকে। এই অর্থ সংশ্লিষ্ট খানার জীবিকা, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তাসহ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়ের অন্যতম উৎস। মাংস আমদানী বৃদ্ধি করা হলে এসব খামারীর জীবন/জীবিকা মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। তাছাড়া সম্প্রতি গড়ে উঠা গরু/ছাগলের বাণিজ্যিক খামারসমূহ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যেতে পারে যা এসব খামারে কর্মরত লক্ষ লক্ষ মানুষকে বেকারত্বের দিকে ঠেলে দিবে। সামগ্রিকভাবে একথা বলাই যায়, মাংস আমদানী ধীরে ধীরে এদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিবে।

চামড়া চামড়াজাত পণ্যখাতে প্রভাব: দেশে উৎপাদিত এবং জবাইকৃত গরু/মহিষ ও ছাগল/ভেড়া শুধু মাংসই উৎপাদন করে না বরং চামড়াসহ অন্যান্য slaughter house by product উৎপাদন করে। বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১৮ কোটি বর্গফুট গরু/মহিষ এবং ছাগল/ভেড়ার চামড়া উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাত করে জুলাই-অক্টোবর ২০১৯-এ চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানীর মাধ্যমে বাংলাদেশ আয় করে প্রায় ২,৯০০ কোটি টাকা যা বাৎসরিক হিসাবে প্রায় ৮,৭০০ কোটি। অধিকহারে মাংস আমদানীর ফলে বাংলাদেশের অন্যতম অর্থকরী চামড়াখাত মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখামুখি হতে পারে। এরফলে রপ্তানী আয় কমার পাশাপাশি এখাতে কর্মরত প্রায় ৫৬ লক্ষ জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে।

কৃষিক্ষেত্রে প্রভাব: বাংলাদেশের প্রায় ৮৬ লক্ষ হেক্টর আবাদি জমির অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ৫% জৈব পদার্থের তুলনায় গড়ে মাত্র ১.৯৬% জৈব পদার্থ রয়েছে। জৈব পদার্থ মাটির প্রাণ। যার অভাবে দেশে খাদ্য উৎপাদন বিপুলভাবে ব্যাহত হবে। এদেশে গবাদিপশু প্রতি বছর প্রায় ১২ কোটি মেট্টিক টন গোবর সার উৎপাদন করে। যার ৮৩% গরু/মহিষ উৎপাদন করে। এই গোবরই বাংলাদেশের চাষকৃত জমির অন্যতম জৈব পদার্থের উৎস। অধিকহারে মাংস আমদানীর ফলে এদেশের গবাদিপশুর উৎপাদন কমবে ফলে জমিতে জৈব পদার্থ সরবরাহের হার কমতে থাকবে। ফলশ্রুতিতে দেশে খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে যা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তাকে বিপন্ন করবে।

প্রাণিসম্পদ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য শিল্পখাতে প্রভাব : বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ খাতের খাদ্য, ঔষধ এবং সংশ্লিষ্ট মেশিনারিজখাতে ক্ষুদ্র থেকে মাঝারী অসংখ্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানসহ বৃহদাকার অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। একইভাবে ছোট বড় প্রায় ২২৬ ফিড মিলে ৪০ লক্ষ টন প্রাণীর খাদ্য উৎপাদন ৪৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে এবং বিনিয়োগ হচ্ছে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। এদেশে প্রায় ১ লক্ষ ৫১ হাজার মাংসের দোকানে প্রায় ৪ লক্ষ ৫০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। সম্ভাবনাময় মাংসখাতকে সামনে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে গড়ে উঠেছে বেঙ্গলমিট, দেশীমিট এবং আরো বেশকিছু মিট প্রসেসিং ইন্ডাষ্ট্রিজ যেখানে কয়েক হাজার লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। এছাড়াও ভেটেরিনারি, টিকা ও ঔষধ সংশ্লিষ্ট প্রায় ৭০০ কোম্পানি দেশে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা মূল্যের ব্যবসা করছে, যেখানে প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষিত লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। বিদেশ থেকে মাংস আমদানীর মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠিত শিল্প/পেশাসহ বিকাশমান শিল্পের অপমৃত্যু হতে পারে, বেকার হতে পারে লক্ষ লক্ষ মানুষ।

আর্থিকখাতে প্রভাব : বাংলাদেশে প্রাণিসম্পদ উৎপাদনে বিভিন্ন ব্যাংক এবং ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী সংস্থাসমূহ বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে। দেশে বর্তমানে ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী সংস্থাসমূহ মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন খাতে প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ প্রদান করে থাকে। এরমধ্যে শুধু প্রাণিসম্পদ খাতেই বিনিয়োগ হয় ২০-২৫ হাজার কোটি টাকা। এ বিনিয়োগের অধিকাংশই হয়ে থাকে গ্রামীণ অর্থনীতিতে।মাংস আমদানীর ফলে এখাতে বিনিয়োগ ধীরে ধীরে হ্রাস পাবে যা গ্রামীণ অর্থনীতিসহ ব্যাংক ও ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ ক্ষেত্রকে আরো সংকুচিত করবে। এরফলে দেশে দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রম ব্যাপকভাবে ব্যাহত হবে।

পরিবেশের ক্ষেত্রে প্রভাব : বাংলাদেশে গবাদিপশু পালন এদেশের গ্রামীণ কৃষি ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখানে কৃষিখাতে বিভিন্ন উপজাত যেমন- খড়, ক্ষুদ, কুড়া, ভূষিসহ ঘাস-লতাপাতা খাইয়ে এদেশের গরু/মহিষ/ছাগল/ভেড়া পালন করা হয়। আবার গরু/মহিষের গোবর জ্বালানি হিসাবে ব্যবহারসহ ফসলের জমিতে জৈবসার হিসাবে প্রয়োগ করা হয়। এ পদ্ধতিটি তুলনামূলকভাবে পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই। অন্যদিকে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনায় গরুকে চারণভূমিতে ছেড়ে পালন করা হয়। প্রতি হেক্টর জমিতে গড়ে ১.৮টি হিসাবে গরু পালন করে। এই চারণভূমি মূলত আমাজন রেইন ফরেস্ট পুড়িয়ে প্রস্তুত করা হয়। প্রতিটন ব্রাজিলিয়ান মাংস উৎপাদনে প্রায় ৩.৫ হেক্টর চারণভূমির প্রয়োজন হয়। সারা বিশ্বে বর্ধিতহারে মাংস রপ্তানীর জন্য ব্রাজিলে প্রতি বছর হাজার হাজার হেক্টর গ্রীষ্মমন্ডলীয় বনাঞ্চল উজাড় করা হয়। ধ্বংস করা হয় হাজার হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী। এভাবে ধ্বংস হয় “পৃথিবীর ফুসফুস” খ্যাত আমাজান বন, উষ্ণতর হয় পৃথিবী। যার চরম শিকার হচ্ছে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় ৬০০ কোটি মানুষ।

যেখানে বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি জলবায়ূ পরিবর্তনজনিত ক্ষতির সম্মুখীন দেশের মধ্যে অন্যতম, সেখানে চরম পরিবেশ বিধ্বংসী প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত মাংস বাংলাদেশে আনয়ন আমাদের নিজেদের পায়ে নিজে কুড়াল মারার সামিল।

সামাজিক ক্ষেত্রে প্রভাব : বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২০ লক্ষ যুবক কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য ঝউএ-এর লক্ষ্য অনুযায়ী কর্মসংস্থান করা সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। এজন্য অনেক শিক্ষিত যুবক উদ্যোক্তা হিসেবে কৃষির বিভিন্ন খাতকে বেছে নিয়েছে। এখানে স্বকর্মসংস্থানের পাশাপাশি মজুরিভিত্তিক  কর্মসংস্থান হচ্ছে। এর অন্যতম প্রধান খাত হচ্ছে প্রাণিসম্পদ খাত বিশেষত গরু/ছাগল পালন। প্রতি টন মাংস উৎপাদনে (পশুপালন, বাজারজাতকরণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণন) প্রায় ৪০ জন মানুষের কর্মসংস্থান হয়। ফলে প্রাণিসম্পদ খাতের মাধ্যমে বিভিন্ন পর্যায়ে বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান হচ্ছে যা দেশের আর্থসামাজিক অস্থিতিশীলতা, আয় বৈষম্য এবং শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় নীরব ভূমিকা পালন করছে। এদেশে সরাসরি মাংস আমাদানীর ফলে কর্ম-সংস্থানের ক্ষেত্র সংকুচিত হবে তথা বেকারত্ব বৃদ্ধি পাবে, যা সামাজিক অস্থিতিশীলতা এবং শান্তি-শৃঙ্খলার অবনমন ঘটাবে।

প্রথম অলোর তথ্যানুসারে ২০১৭-১৮ অর্থ-বছরে বাংলাদেশে মাংস আমদানী হয়েছিল ২৪ লক্ষ ৭৯ হাজার ডলার এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মাংস আমদানী হয়েছিল ৭ লক্ষ ২৮ হাজার ডলার। এর মধ্যে ভারত হতে আমদানী হয়েছিল সর্বোচ্চ পরিমাণ। চলতি ২০১৯ বছরে এপ্রিল-জুলাই মেয়াদে ভারত হতে মোট মাংস আমদানী হয়েছে ৫৪৭ টন। এ হারে আমদানী করা হলে ভারত হতে বছরে মাংস আমদানীর পরিমাণ হবে প্রায় ১৮৬১ টন। বিগত বছরে ব্রাজিল সহ অন্যান্য দেশ থেকে যে পরিমাণ মাংস আমদানী করা হয়েছিল তা যদি চলতি বছরেও করা হয় তবে বছর শেষে মোট আমদানীকৃত মাংসের পরিমাণ হবে প্রায় ২৫০০-৩০০০ টন।  এর অর্থ দাঁড়ায় শুধু এ বছরেই ১০-১২ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান থেকে দেশ বঞ্চিত হবে। ব্রাজিল বা অন্যান্য দেশ থেকে প্রতিবছর যে হারে মাংস আমদানী বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে এদেশের নিজস্ব গবাদিপশুর উৎপাদন ব্যবস্থা অচিরেই ধ্বংস হয়ে যাবে। বৃদ্ধি পাবে বেকারত্ব, ধ্বংস হবে গ্রামীণ অর্থনীতি যা এদেশকে সামগ্রিকভাবে পিছনে ঠেলে দিবে।

সাম্প্রাতিক সময়ে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের ফলে দেশ মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এ সময়ে যখন মাংস রপ্তানীর উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন তখন মাংস আমদানীর প্রস্তাবনা সার্বিক বিবেচনায় অগ্রহণযোগ্য। তাছাড়া, সরকার সম্প্রতি দেশে দুধ ও মাংস বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় ৪২০০ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এদেশে, বর্ধিতহারে মাংস আমদানী অব্যহত থাকলে এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য নিশ্চিত বিফলে যাবে।

এদেশে মাংসের প্রায় ৪৫% আসে পোল্ট্রি খাত হতে। মাংস রপ্তানীকারক দেশসমূহ এদেশের গরু/মহিষের বাজার দখল করার সাথে সাথে বাণিজ্যিক পোল্ট্রি শিল্পের দিকে নজর দেবে। বাংলাদেশের তুলনায় অনেক সস্তায় উৎপাদিত পোল্ট্রি মিট এদেশের বাজারে প্রবেশ করলে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ ও প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থানকারী এখাতও ধ্বংসের মুখোমুখী হবে।

বর্ণিত প্রেক্ষিতে আমরা নিম্নোক্ত সুপারিশসমূহ প্রস্তাব করছি:

১. গ্রামীণ অর্থনীতি, কর্মসংস্থান, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা, বৈশ্বিক পরিবেশ সংরক্ষণ ও জাতীয় অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা তথা জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে এদেশে মাংস আমদানী বন্ধ করা। প্রয়োজনে এ বিষয়ে WTO-এর বিশেষ ব্যবস্থাধীন দেশীয় খামারীর স্বার্থ সংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণ করা।

২. বাংলাদেশে গুণগত ও পরিমাণগত মানসম্পন্ন Beef Primal এবং Boneless Beef উৎপাদনের উদ্যোগ গ্রহণ করা। এর ফলে স্থানীয় High-end Market –এ এসব মাংসের চাহিদা স্থানীয়ভাবে মেটানো সম্ভব হবে।

৩. বাংলাদেশ থেকে মাংস রপ্তানীর ক্ষেত্রে দেশের সংশ্লিষ্ট Policy Environment নিশ্চিত করা। মাংস রপ্তানীর ক্ষেত্রে OIE এবং WTO এর বিভিন্ন Compliance নিশ্চিত করা।

৪. দেশে জনস্বাস্থ্য, জীব-নিরাপত্তা ও Sanitary/Phyto Sanitary Compliance  নিশ্চিতকল্পে মাংস ও মাংসজাত পণ্যের আমদানী/রপ্তানীর ক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে সম্পৃক্ত করা।

লেখক: মহা ব্যবস্থাপক, পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন এবং সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বিএলআরআই।

This post has already been read 4246 times!