Friday 19th of April 2024
Home / পরিবেশ ও জলবায়ু / হাঁটুপানির বাঁধে দাঁড়িয়ে ঈদের নামাজ আদায় কয়রাবাসীর!

হাঁটুপানির বাঁধে দাঁড়িয়ে ঈদের নামাজ আদায় কয়রাবাসীর!

Published at মে ২৫, ২০২০

পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ নির্মাণে বরাদ্দকৃত অর্থ লুটপাটের খেসারত

ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা)

ঈদ আনন্দ নেই উপকূলের লাখো পরিবারে। করোনাকালে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝর আম্পানের তান্ডবে তাদের ঘরবাড়ি ফসল লন্ডভন্ড করেছে । এবারের ঈদের নামাজ উপকূলের মানুষ বাঁধের উপর হাটুপানিতে আদায় করছে । ঘূর্ণিঝড় ‘আম্ফান উপকূলবাসীর এতই ক্ষতি করেছে তা ভাবা যায়না । তবে প্রকৃতিক এই দুর্যোগের লক্ষ লক্ষ পরিবারকে গৃহহীন করার জন্য দায়ি পানি উন্নয়ন বোর্ড । খুলনা জোনে বাঁধ নির্মাণে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অনীহার কারণেই আজ উপকুলের মানুষকে লোনা পানিতে ডুবতে হল। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ নির্মাণে বরাদ্দকৃত অর্থ লুটপাটের খেসারত দিতে হচ্ছে উপকূলীয় জনপদের মানুষদের ।

সংগত কারনেই সুপার সাইক্লোন আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের উপর হাটু পানিতে দাঁড়িয়ে কয়রাবাসী ঈদের নামাজ আদায় করেছেন। নামাজ শেষে তারা আবার বাঁধ মেরামতের কাজে নেমে পড়েন। তাদের একটাই স্লোগান ‘ত্রান নয় চাই সুরক্ষিত বেড়িবাঁধ’ ভয়াল ২৫ মে আজ। এ দিনেই ২০০৯ সালে উপকূলীয় অঞ্চলে আইলার আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়। আইলায় খুলনার উপকূলীয় কয়রার বাঁধ ভেসে যায়। কিন্তু ১১ বছরেও তা নির্মিত হয়নি। এর মধ্যে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে তছনছ হয়ে গেছে সব। এখন কয়রার মানুষ নিজেরাই স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ তৈরি করছেন। আইলার আঘাতের সেই দিবসেই এবার পবিত্র ঈদুল ফিতর পালিত হচ্ছে।দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়েই নামাজ শেষে সেমাই খেয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ তৈরি উৎসবে নামে খুলনার উপকূলীয় কয়রাবাসী। দুপুরে তাদের জন্য আয়োজন করা হয়েছে খিচুড়ির। এভাবেই ঈদের দিন বাঁধ মেরামতের উৎসব পালন করছেন আইলা ও আম্পানে ক্ষতবিক্ষত হওয়া কয়রার মানুষ।

প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলার আঘাতে কয়রার পাউবোর বেড়িবাঁধের ২৭টি পয়েন্ট জলোচ্ছ্বাসে ভেঙে লোনা পানিতে তলিয়ে যায়। ২০ মে আম্পানের আঘাতে কয়রার বেড়িবাঁধের ২৪ পয়েন্ট ভেঙে আবারও লোনা পানিতে সয়লাব হয়।

আইলায় আঘাতের পর দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের আংটিহারা, খাসিটানা, জোড়শিং, মাটিয়াভাঙা উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের গাতিরঘেরি, গাববুনিয়া, গাজিপাড়া, কাটকাটা, কয়রা সদর ইউনিয়নের ৬নং কয়রা, ৪নং কয়রার পুরাতন লঞ্চঘাট সংলগ্ন এলাকা, ঘাটাখালি, হরিণখোলা, মহারাজপুর ইউনিয়নের উত্তর মঠবাড়ি, দশালিয়া, লোকা, মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের কালিবাড়ি, নয়ানি, শেখেরটেক এলাকার বেড়িবাঁধ অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। গত ১১ বছর ধরে কয়রার মানুষ এসব বেড়িবাঁধ সংস্কার করার আন্দোলন করে। আইলার ৩ বছর পর ২০১২ সালে পবনা বাঁধ, হারেজখালি, পদ্মপুকুর, শিকারিবাড়ি, পাথরখালি বাঁধ মেরামত করা হয়। কিন্তু তারপর থেকে কয়রার ৬টি ইউনিয়নের কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদীর তীরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৬০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধে পর্যাপ্ত মাটি পড়েনি।

পাউবো সূত্র অনুযায়ী, আইলার পর ‘উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্প ফেজ-১’ এর আওতায় খুলনাসহ উপকূলীয় ৬২৫ কিলোমিটার বাঁধ পুনঃনির্মাণে বৃহৎ প্রকল্প ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে খুলনা জেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়), ৮৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে খুলনার দাকোপে ৩১ নং পোল্ডার এবং বটিয়াঘাটায় ৩০ ও ৩৪/২ পোল্ডারে বাঁধ পুনঃসংস্কার কাজ করা হয়েছে। কিন্তু এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও এ অঞ্চলের বেড়িবাঁধ নিয়ে মানুষের আতঙ্ক কমেনি। ২০১৯ সালের ৪ মে ঘূর্ণিঝড় ফনী ও ১১ নভেম্বর বুলবুলের সময় উপকূলীয় কয়রা ও দাকোপে বড় আতঙ্ক ছিল বেড়িবাঁধ। আর গত ২০ মে আম্পানের সময় এ আতঙ্ক প্রবল হয়ে ওঠে। আম্পানের আঘাতে কয়রার বাঁধ ধ্বসে যায়। সমগ্র কয়রা এখন লোনা পানির বদ্ধ এলাকায় পরিণত হয়েছে।

কয়রার বাসিন্দা সিরাজুদ্দৌলা লিঙ্কন বলেন, আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়রায় আসেন এবং এলাকা পরিদর্শন করেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এলাকায় টেকসই ও স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করার। তারপর কয়রা এলাকায় বাঁধ নির্মাণে প্রতি বছরই অর্থ বরাদ্দ হয়। কিন্তু এ অর্থ কোথায় কীভাবে ব্যয় হয় তা মনিটরিং করার কেউ ছিল না। ফলে বাঁধ নির্মাণের নামে কথিত ‘জরুরি কাজ’ অজুহাতে বাঁধের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ লুটপাট হয়। এখন যার খেসারত দিচ্ছে কয়রাবাসী।

কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দিন বলেন, কয়রার মানুষ বাঁধ মেরামত না করা পর্যন্ত ঘরে ফিরে যাবে না। কারণ বাঁধ আটকাতে না পারলে লোনা পানির মধ্যে বসবাস করা কঠিন হবে। কয়রার মানুষ এখন ত্রাণ চায় না, বাঁধ চায়। তাই সবাই মিলে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ নির্মাণে মরিয়া হয়ে উঠেছে। স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করলেও তাদের পেটে দানা পানি প্রয়োজন। উপজেলা প্রশাসন সেটুকুর জোগান দিয়ে লোনাপানিতে বিধ্বস্ত মানুষগুলোকে উৎসাহ দিচ্ছেন।

দক্ষিণ বেদকাশীর বাসিন্দা আবু সাঈদ খান বলেন, আইলায় বাড়ি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর মানুষ বাঁধের ওপর আশ্রয় নিতে পেরেছিলেন। কিন্তু আম্পানে ঘর বাড়ি, বাঁধ সবই। তাই মানুষের ন্যূনতম আশ্রয় নেওয়ার অবস্থাও নেই। বাধ্য হয়ে এখন মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে আগে বাঁধ নির্মাণে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাদা জলে নেমে পড়েছেন।

কয়রা উপজেলার ৩নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য আব্দুল গফ্ফার ঢালি বলেন, বাঁধ নির্মাণে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অনীহার কারণেই আজ কয়রার মানুষকে লোনা পানিতে ডুবতে হল। জোড়াতালির কাজ কোনও কাজেই আসেনি। কিন্তু অর্থের অপচয় হয়েছে। উত্তর বেদকাশি ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ্ব সরদার নুরুল ইসলাম বলেন, আইলার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আন্দোলন ধুলিষ্যাৎ করে দিলো আম্পান। টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হলে এখন কয়রার মানুষকে এত ভোগান্তি পোহাতে হত না। কয়রা সদর ইউনিয়নের ৯নং ওর্য়াডের ইউপি সদস্য হরেন্দ্রনাথ সরকার বলেন, আইলার পর থেকে এ জনপদের মানুষ বেড়িবাঁধ নিয়ে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করেছেন। আম্পানের আঘাতে সেই যুদ্ধ আবার নতুনভাবে শুরু করতে হল।

কয়রা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম শফিকুল ইসলাম বলেন, কয়রাবাসীর বেড়িবাঁধ নিয়ে আন্দোলন ২৫ মে থেকে নতুন মাত্রায় যুক্ত হবে। এখন পর্যন্ত টেকসই বাঁধ স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিজস্ব কিছু ঠিকাদার দিয়ে করা কাজের মান ছিল নিম্মমানের। ফলে আম্পানের আঘাতে সেসব স্থানই আগে ভেঙেছে আর এলাকা লোনা পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এখানে ভালো ফসল হয়, মাছ চাষ হয়। এখন কয়রার মানুষ বাঁধ চায়। ত্রাণের দরকার হবে না। প্রয়োজন টেকসই বাঁধ।

কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিমুল কুমার সাহ বলেন, আইলা বিধ্বস্ত কয়রা এখন আম্পানে বিধ্বস্ত হয়ে আরও মুখ থুবড়ে পড়েছে। কয়রার ৪টি ইউনিয়রে সমগ্র এলাকা লোনা পানিতে তলিয়ে রয়েছে। কয়রার মানুষ এখন স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বাঁধ নির্মাণে ব্যস্ত সময় পার করছেন। তারা ঈদের দিন বাঁধের ওপরই নামাজ আদায় করে সেমাই খেয়ে মেরামতে নেমে পড়েছেন। দুপুরে তাদের জন্য খিচুড়ির আয়োজন রয়েছে।

This post has already been read 3026 times!