Thursday 25th of April 2024
Home / পোলট্রি / সোনালী মুরগির বাচ্চার ব্রুডিং ব্যবস্থাপনার আদ্যোপান্ত

সোনালী মুরগির বাচ্চার ব্রুডিং ব্যবস্থাপনার আদ্যোপান্ত

Published at নভেম্বর ১৪, ২০১৯

মো. মহির উদ্দীন, কৃষিবিদ : মুরগির বাচ্চাকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ঋতুভেদে ২-৪ সপ্তাহ কৃত্রিমভাবে তাপ দিতে হয়। সোনালী মুরগিও এর ব্যাতিক্রম নয়। কৃত্রিম উপায়ে এই তাপ দেয়াকে বলা হয় ব্রুডিং। ব্রুডিং এর উদ্দেশ্য হলো মুরগির বাচ্চার জন্য আরামদায়ক ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করা। ব্রুডিং পিরিয়ডের অনিবার্য বিবেচ্য বিষয়গুলো হলো-

১. কাঙিক্ষত তাপমাত্রা।
২. বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা।
৩. বায়ু চলাচল বা ভেন্টিলেশন, এবং
৪. পরিমিত আলোর উপস্থিতি।

কাঙিক্ষত তাপমাত্রা : ব্রুডিং পিরিয়ডে বিশেষ করে মুরগির বাচ্চার জীবনের প্রথম দুই সপ্তাহ সঠিক তাপমাত্রা মেইনটেন করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রাথমিক অবস্থায় মুরগির বাচ্চার থার্মোরেগুলেটরী সিস্টেম বা মেটাবলিক প্রসেস পরিপূর্ণভাবে কার্যকর থাকেনা। সদ্য ফোটা মুরগির বাচ্চার শরীরের তাপমাত্রা পরিবেশের তাপমাত্রার চেয়ে বেশি থাকে। এ কারণে এ সময়ে মুরগির বাচ্চাকে তার দৈহিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য পরিবেশের তাপমাত্রার ওপর নির্ভর করতে হয়। তাই স্বাভাবিক দৈহিক তাপমাত্রা ঠিক রাখার জন্য বাহির থেকে তাপ প্রদানের দরকার হয়। প্রথম সপ্তাহে ব্রুডার হাউজের তাপমাত্রা ৯৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট থাকা দরকার এবং প্রতি সপ্তাহে তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি করে কমাতে হবে ৭৫ ডিগ্রি ফারেনহাইটে না আসা পর্যন্ত। তাপমাত্রা পরিমাপের জন্য মুরগির বাচ্চার উচ্চতায় থার্মোমিটার স্থাপন করতে হবে। বাচ্চাকে সমভাবে তাপ প্রদান এবং বাচ্চার চলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্রুডার গার্ড ব্যবহার করতে হবে। বয়স ৩দিন পর থেকে ধীরে ধীরে ব্রুডার গার্ড সরিয়ে স্পেস বাড়াতে হবে এবং বয়স সাধারণত দুই সপ্তাহ হলে ব্রুডার গার্ড সরিয়ে ফেলতে হবে।

বাচ্চা শেডে প্রবেশের ৪৮ ঘণ্টা আগেই শেড প্রস্তুত করতে হবে এবং তাপমাত্রা উঠানোর জন্য কমপক্ষে ৬ ঘণ্টা আগে ব্রুডার চালু করতে হবে। শেডে বাচ্চা প্রবেশের ২-৩ ঘণ্টা পর নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে ব্রুডিং হাউজের তাপমাত্রা পরিমাপ করা যায়। যদি মুরগির বাচ্চা তাপের উৎসের কাছাকাছি জড়ো হয় তাহলে বুঝতে হবে আরো তাপ দরকার সেক্ষেত্রে ব্রুডারে অতিরিক্ত বালব্ লাগিয়ে অথবা ব্রুডার গার্ডার একটু ছোট করে দিয়ে তাপ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আবার তাপমাত্রা খুব বেশি হলে বাচ্চা তাপের উৎস থেকে দূরে দূরে থাকবে। সেক্ষেত্রে বালব কমিয়ে বা ব্রুডার গার্ডারের আয়তন বাড়িয়ে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আর যদি বাচ্চা ব্রুডার গার্ডের মধ্যে সমভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থেকে স্বতঃস্ফুর্ত চলাচল করে তাহলে বুঝতে হবে তাপমাত্রা সঠিক আছে। অর্থাৎ বাচ্চার আচরণই বলে দিবে তাপমাত্রা বেশি না কম হয়েছে।

একজন অভিজ্ঞ খামারি এটা দেখে সহজেই মুরগির বাচ্চার কাক্সিক্ষত তাপমাত্রা সমন্বয় করতে পারবেন। মনে রাখতে হবে ব্রুডিং পিরিয়ডে যদি সঠিক পরিমাণ তাপ প্রদান করা না হয় তাহলে মুরগির ভবিষ্যৎ উৎপাদন দক্ষতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ব্রুডিং এর সময় যদি তাপমাত্রা অতিরিক্ত কম বা বেশি হয় তাহলে মুরগির বাচ্চার বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, খাদ্য রূপান্তর হার কমে যায় এবং রোগ সংক্রমণের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। একদিন বয়সের মুরগির বাচ্চার দৈহিক তাপমাত্রা ১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট। যখন বেশি তাপমাত্রা বেশি সময় ধরে পালিত হয় এর ফলে মৃত্যুহার বেড়ে যায় এবং ভবিষ্যৎ পারফরমেন্স ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবার যখন কম তাপমাত্রায় থাকলে মুরগির বাচ্চার রোগ প্রতিরোধ ও পরিপাক সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঠা-াজনিত ধকলের কারণে মুরগির বাচ্চার বৃদ্ধি কমে যায় রোগবালাইয়ের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ব্রুডিং পিরিয়ডে তাপমাত্রা কম হলে মুরগির বাচ্চার এসাইটিজ নামক মেটাবলিক রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। এর ফলে পারফরমেন্স কমে যায় এবং মৃত্যুহার বেড়ে যায়। কম তাপমাত্রায় ব্রুডিং করলে বাজারজাতকরণের সময় সঠিক ওজনে আসেনা। ব্রুডিং তাপমাত্রা কম হলে শুধুমাত্র দৈহিক বৃদ্ধিই কমে যায় না। দৈহিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে দেহ গরম রাখতে বেশি খাদ্য গ্রহণ করে এর ফলে খাদ্য খরচ বেড়ে যায়। সুতরাং ব্রুডিং পিরিয়ডে একজন খামারির লক্ষ্য হবে একটি আরামদায়ক ও স্বাচ্ছন্দ্যবোধের পরিবেশ তৈরি করা যা মুরগির বাচ্চার আচরণ দ্বারা নির্দেশিত হবে।

বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা : মুরগির উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে ঘরে আর্দ্রতার বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। মুরগির ঘরে কাক্সিক্ষত আপেক্ষিক আর্দ্রতা হলো ৫০-৭০%। মুরগির পায়খানার সরপৎড়নরড়ষড়মরপধষ নৎবধশফড়হি এর কারণে অ্যামোনিয়া গ্যাস উৎপন্ন হয়। যদি ঘরে আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৫০% এর কম হয় তাহলে লিটার ধুলিময় হয় এবং বাচ্চা পানিশূন্যতায় ভুগবে যা মুরগির ভবিষ্যৎ উৎপাদন দক্ষতাকে বাধাগ্রস্ত করবে। প্রথম ৩ দিন মুরগির বাচ্চার ঘরে ৭০% আপেক্ষিক আর্দ্রতা থাকা দরকার। আর্দ্রতা ৭০% এর বেশি হলে লিটারে বিভিন্ন ক্ষতিকর অনুজীবের বংশ বিস্তারের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি হবে। অনুজীবের সংখ্যা যত বেশি হবে তত বেশি অ্যামোনিয়া গ্যাস তৈরি হবে। মুরগির ঘরে অ্যামোনিয়া গ্যাসের উপস্থিতির কারণে মুরগির স্বাস্থ্য ও পারফরমেন্সের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মুরগির স্বাচ্ছন্দ্যবোধ নির্ভর করে মুরগির ঘরের আর্দ্রতার পরিমাণের ওপর। ব্রুডিং পিরিয়ডে অতিরিক্ত অ্যামোনিয়া গ্যাসের কারণে মুরগির বাচ্চার দৈহিক বৃদ্ধি বিঘিœত হয়।

ভেন্টিলেশন : ভেন্টিলেশন বলতে মুরগির ঘরে বায়ু চলাচলকে বুঝায়। মুরগির বাচ্চার স্বাস্থ্য, স্বস্তি এবং তাপ রেগুলেট করার জন্য ভেন্টিলেশন বা বায়ু চলাচল বিশেষ ভূমিকা রাখে। ব্রুডিং এর সময় পর্যাপ্ত ফ্রেশ বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ভেন্টিলেশনের ফলে ঘর থেকে অতিরিক্ত আর্দ্রতা ও ক্ষতিকর গ্যাস বের হয়ে যায় এবং বিশুদ্ধ বাতাস ঘরে প্রবেশ করে। থাম্বরুল অনুযায়ী অনূন্য ভেন্টিলেশন বায়ু প্রবাহের হার ১ ঘনমিটার/কেজি/ঘণ্টা। এটা নির্ভর করে বাইরের তাপমাত্রা এবং ভেতরের বাতাসের কোয়ালিটির ওপর। মুরগির ঘরে ভালো বায়ু চলাচল বা উন্নত ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা মুরগির ভালো ব্যবস্থাপনার একটি অন্যতম বিষয়।

পরিমিত আলো : মুরগির ঘরে সঠিক পরিমাণ এবং সমভাবে আলোক প্রদান বেশ জটিল। আলো এমনভাবে প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে পুরো ঘর একইভাবে আলোকিত হয়। আলোর প্রয়োজনীয়তা হলো মুরগির বাচ্চাকে প্রথম দিনেই পানি ও খাদ্য চিনে খেতে সহায়তা করে। প্রথম ৩ দিন ২৩ ঘণ্টা আলো প্রদান করতে হবে এবং আলোর তীব্রতা হবে সর্বনিম্ন ২০ লাক্স। ৩দিন পর প্রাত্যহিক আলোক প্রদানের সময় কমিয়ে আনতে হবে ৮-১২ ঘণ্টায় এবং আলোর তীব্রতা হবে ১০-২০ লাক্স।

This post has already been read 4742 times!