Thursday 25th of April 2024
Home / অর্থ-শিল্প-বাণিজ্য / সুদমুক্ত কৃষি ঋণ ও প্রণোদনার স্বচ্ছ ব্যবহার নিশ্চিতের দাবী

সুদমুক্ত কৃষি ঋণ ও প্রণোদনার স্বচ্ছ ব্যবহার নিশ্চিতের দাবী

Published at এপ্রিল ১৪, ২০২০

নিজস্ব প্রতিবেদক: ”দেশের বর্তমান বাস্তবতায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের জন্য প্রদত্ত কৃষি সহায়তা সম্পূর্ণ সুদমুক্ত হওয়া দরকার ছিল” বলে মনে করে নাগরিক সংগঠন বিসেফ ফাউন্ডেশন। গত রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা  কর্তৃক কৃষি খাতে (পোলট্রি, কৃষি ফার্ম, ফলমূল, মসলাজাতীয় খাদ্যপণ্য উৎপাদন) সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ সুদে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ফান্ড তৈরির প্রতিক্রিয়ায় এমনটি জানানে হয়। করোনা পরিস্থিতিতে  কৃষি পণ্য পরিবহনে এক বিশাল ছেদ পড়েছে। বিভিন্ন স্থানে কৃষক তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে পারছেন না। লকডাউনে পণ্য পরিবহনে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষত: সবজি, দুধ, মাছ ও ডিমের মতো পণ্যের ক্ষেত্রে এই অবস্থা ভয়াবহ সমস্যা তৈরি করেছে বলে মনে করছে সংগঠনটি।

সংগঠনটির মতে, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির দায়িত্বে কৃষক থাকলেও কৃষিপণ্য বিক্রি বা বাজারজাত করণের দায়িত্বে থাকে ব্যবসায়ীমহল। কৃষক যদি তার উৎপাদিত পণ্য নায্যমূল্যে বিক্রি করতে না পারে তাহলে উৎপাদিত ফসল কৃষকের গলার ফাঁস হয়ে যেতে পারে। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে সেটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আগামীতে কৃষক ঋণ নিয়ে কৃষিকাজ করতে ভয় পাবে, সে ক্ষেত্রে `সুদ’ প্রদান নয় `আসল’ দেয়াটা তার কাছে ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিতে পারে।

একদিকে স্থানীয়ভাবে চাহিদা-যোগানে ভারসাম্য নেই, কৃষকের জন্য বাজার দর কম, অপরদিকে শহরে সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়ায় ক্রেতারা বেশি দামে পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। পাইকার, ক্ষুদ্র বিক্রেতা, শ্রমিক, পণ্য পরিবহন সিস্টেম, সবার কাজেই এর প্রভাব পড়েছে এবং প্রায় সকলেই আয় হারাচ্ছেন। তৃণমূলে কৃষকের মুলধন হারাচ্ছে  আবার ক্রেতাদের আয় কমে যাওয়ায় বেশি দাম দেওয়াটাও কঠিন হয়ে পড়েছে। এ অবস্থা চললে নতুন করে ঋণ গ্রহণের সক্ষমতাই থাকবে না।

দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বিসেফ ফাউন্ডেশন সরকারের কাছে ৬টি প্রস্তাব করেছে-

১.  অবিলম্বে কৃষির জন্য ঘোষিত প্রণোদনার অর্থ সুদমুক্ত ঘোষণা করা হোক; আগের ঋণের সুদ মওকুফ করা হোক। খাদ্য নিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্যের জন্য এই বিনিয়োগ সরকারকেই সহায়তা করবে।

২. সরকারের উদ্যোগে কৃষি পণ্য পরিবহন ও বাজার সুরক্ষায় সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হোক;  (কৃষি সম্প্রসারণ ও বিপণন বিভাগ, হরটেক্স ফাউন্ডেশন, অত্যাবশ্যকীয়ভাবে যুক্ত থেকে সহায়তা করুক। ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, স্থানীয় সরকার এবং বিসেফ ফাউন্ডেশনও এক্ষেত্রে সরকারকে সহায়তা করতে পারে।)  কৃষি পণ্য পরিবহন ও কৃষিকাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের চলাচল নির্বিঘ্ন করতে তাদের ‘ বিশেষ পাশ’ প্রদান এবং সরকারি পরিবহনে সামাজিক দুরত্বের নিয়ম মেনে তাদেরকে সীমিত পরিসরে চলাচলের সুযোগ প্রদানেরও প্রস্তাব করছি।

৩. ভুক্তভোগী সুবিধাবঞ্চিতদের নগদ অর্থ সহায়তা দেয়া হোক যাতে তারা বাজার থেকে নিজেরাই পছন্দমত খাবার সংগ্রহ করতে পারে;  স্থানীয়ভাবে ডাটা বেজ তৈরি করে দরিদ্র ও বিত্তহীন মানুষকে এর আওতায় আনতে হবে। আগামী ২ মাসের মধ্যে এই ডাটাবেজ তৈরি করতে হবে। ত্রাণ বিতরণে স্বচ্ছতার জন্য এটি বিশেষ জরুরি। স্থানীয়ভাবে খাদ্য সহায়তা তালিকায় দুধ, ডিম, মাছ, মাংস (যেখানে যেটা সম্ভব) যুক্ত করা হোক

৪. প্রত্যেক ইউনিয়ন তথ্য কেন্দ্র, উপজেলা অফিস এবং ব্যাংক-এ সহায়তা কেন্দ্র বা হেল্প ডেস্ক চালু করা হোক, যাতে একজন কৃষক হয়রানি বা বিড়ম্বনা ছাড়াই কৃষি ঋণ পেতে পারে।   একটি হটলাইন চালু করা যেখানে একজন কৃষক বা কৃষি উদ্যোক্তা হয়রানির শিকার হলে অভিযোগ জানাতে পারেন। খাদ্য সংকটে থাকা পরিবারও এই হটলাইনে নিজেদের কষ্টের কথা জানাতে পারবেন। সম্ভব হলে জেলা ভিত্তিক হটলাইন চালু হতে পারে।

৫. অবিলম্বে বোরো ধান ক্রয়ের নীতিমালা চূড়ান্ত করা এবং ২৫ লক্ষ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা।  ধান ছাড়াও অন্যান্য সংরক্ষণশীল কৃষি পণ্য সরকারের উদ্যোগে ক্রয়ের ব্যবস্থা করা, প্রয়োজনে বিএডিসি/টিসিবি/বিএফডিসি গুদাম  ব্যবহার করার উদ্যোগ গ্রহণ করা। পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে কৃষকদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করাটাও অধিক জরুরি। তাছাড়া কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের মূল্য নিশ্চিত করতে আমদানী নিয়ন্ত্রণ করাও জরুরি। এই সময়ে পেঁয়াজ আমদানী বন্ধ রাখতে হবে। অক্টেবর নভেম্বরের আগে পেঁয়াজ আমদানীর অনুমতি প্রদান যথার্থ হবে না।

৬. ‘শারিরীক দুরত্ব’ বজায় রেখে বাজার পরিচালনা করা (প্রধানমন্ত্রী উন্মুক্ত স্থানে বাজার পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছেন)। প্রতি উপজেলায় সপ্তাহে ২/৩ দিন কৃষি বাজার পরিচালনা করা যাতে কৃষকরা তাদের দুধ, ডিম, মাছ, অন্যান্য কৃষি পণ্য নিজেরাই বিক্রয় করতে পারেন।

এছাড়াও বিসেফ ফাউন্ডেশন মনে করে, করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে আমাদের সামগ্রিক কৃষি পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে হবে। কৃষিসহ সামগ্রিক অর্থনীতিকে স্বাভাবিক গতিতে ফিরিয়ে আনতে ২-৩ বছর সময় লাগতে পারে। আমাদের অর্থনীতি যেহেতু কৃষি নির্ভর এবং আমাদের কৃষিখাতে যেহেতু ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা বেশি, তাই এই সময়ের শক বা ঝুঁকি মোকাবেলায় সরকারকে বিশেষ পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। এই সময়ে দেশে দরিদ্র লোকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বেড়ে যেতে পারে অপুষ্টিতে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যাও। ফলে এই অভিঘাত মোকাবেলায় সরকারকে আন্তঃসমন্বয় সাধন করে কাজ করতে হবে। এটাকে একটা নতুন ধরণের যুদ্ধ হিসেবে গণ্য করে এই যুদ্ধে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজনটিও এখন গুরুত্বপূর্ণভাবে বিবেচনা করতে হবে।

বিসেফ ফাউন্ডেশন আরো মনে করে, কৃষিকে কেবল শস্য খাত হিসেবে  না দেখে প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য চাষকেও এর সাথে দেখা, কারণ এখানে গ্রামীণ উদ্যোক্তা, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প (ঘি, মাখন ও দুগ্ধজাত পণ্য) এবং পণ্য  সংরক্ষণের বিষয়গুলোও বিবেচনা করা  জরুরি। বিশেষত বিদেশ থেকে চলে আসা অনেকেই এখানে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা হিসেবে যুক্ত হতে পারেন।

This post has already been read 3673 times!