Thursday 28th of March 2024
Home / এক্সক্লুসিভ / সময়ের সংলাপ: ইলিশ অভিযান বাইশ দিন

সময়ের সংলাপ: ইলিশ অভিযান বাইশ দিন

Published at সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৭

goutam

গৌতম কুমার রায়

গৌতম কুমার রায়:
তখন ২০১৪ সন। ০৫-১৫ অক্টোবর পালিত হয়েছিল  মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান। ঐ বছর ১৬ অক্টোবর ঢাকা যেতে পাটুরিয়া ফেরীতে ইলিশ মাছ বিক্রি হচ্ছে দেখে এগিয়ে গেলাম। ঝুড়িতে ইলিশ দেখে আমার চোখতো উঠলো কপালে। তিনটি ইলিশ। প্রতিটি ইলিশের পেটভর্র্তি ডিম।

বিক্রেতাকে জিঞ্জেসা করলাম, কেমন ধরা পরছে ইলিশ?
উত্তরে বলল, ঝাঁকে ঝাঁকে।
বললুম, সব মাছেই কি ডিম?
বলল প্রতিটির পেটে ডিমে ভরপুর।

নিজেকে অপরাধী মনে হলো। গেল ১১ দিনে কত কষ্ট করে কুমারখালির শিলাইদহ পদ্মার ইলিশ ধরা বন্ধ রেখেছি। অথচ এখনও ইলিশের পেটে ভরা ডিম। এরপর পত্রিকার পাতার কারণে জানতে আর অপেক্ষা করতে হলো না যে, পদ্মা থেকে যমুনা কিংবা মেঘনা সবখানেই ধরা পরছে ইলিশ। তা আবার ডিমে ভরা মা  ইলিশ। তখনও প্রায় প্রতিটি মা ইলিশের পেটে ডিম। আমি মা ইলিশ সংরক্ষণের সময় বাড়িয়ে দিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিনীত অনুরোধ জানিয়ে ঢাকার জাতীয় একটি দৈনিকে প্রবন্ধ লিখলাম। কেননা ইলিশ একটি মাইগ্রেটরী মাছ। মৎস্যসম্পদে এককভাবে ইলিশের অবদান সর্বাগ্রে।
hilsha
বিগত ২০১১-১২ অর্থ বছরে দেশে শুধু ইলিশ উৎপাদন ছিল ৩.৪৭ লাখ মে.টন। যার বাজার মূল্য ছিল প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকারও বেশি। ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে ইলিশ এসেছে ৩.৮৭ লাখ মেট্রিক টন। যার মূল্য প্রায় ১৫৪৮০ কোটি টাকা। সুস্বাদু খাদ্য হিসেবে এবং বলতে গেলে এটা আর্টিজেনাল জেলেদের একমাত্র ও অন্যতম আয়ের উৎস বটে। ২০১৬ সনে যে ইলিশ ধরা পরেছে তার পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হবে। দেশের মোট জনগোষ্ঠির ২ শতাংশ মানুষ মাধ্যম হিসেবে বা সরাসরি হিসেবে ইলিশের সাথে জড়িত। সাধারণত শারিরীক বৈশিষ্ঠ্যতায় ইলিশ মাছ ১ বছর পেড়িয়ে পরিপক্কতা পায়। বৈচিত্র্যময় আবহাওয়া এবং পরিবেশের জন্য যেমন- আলো, তাপমাত্রা, পানির গভীরতা, পানির স্রোত এবং প্লাংটনসমৃদ্ধ খাবার প্রাপ্যতার ওপর নির্ভর করে কোন কোন ইলিশ ৮-১০ মাসে পরিপক্কতা পেয়ে যায়।

পরিবেশগত কারণে প্রজনন মৌসুমে পুরুষ ও স্ত্রী ইলিশের অনুপাত ভিন্ন হলেও সাধারণ নিয়মে এই অনুপাত ১ঃ১ হয়ে থাকে। ইলিশের স্বাচ্ছন্দ্যময় প্রজননে দরকার আবাস নিরাপত্তা, গভীরতা এবং জল গতিময়তা বা স্রোত এবং সহনশীল তাপমাত্রা। প্রজনন সময়ে ইলিশ সমুদ্রের প্রায় ১৫০-২০০ ফুট গভীরতা থেকে ক্রমে ক্রমে জলস্রোতের উজানে উঠতে থাকে। মোহনার ৮০-১০০ ফুট গভীরতাকে অতিক্রম করে এই মাছ প্লাংটন সমুদ্ধ জলরাশি বিশেষ করে সুন্দরবন এলাকা হয়ে দিন দিন পশুর, শিবসা, বলেশ্বর, রূপসা, যমুনা, মেঘনা, পদ্মা হয়ে ফারাক্কা বাঁধের আগ পর্যন্ত এবং মধুমতি, গড়াই প্রভৃতি নদীতে উঠে আসে।

ইলিশ সব সময়ে প্লাাংটনভোজি। এই মাছের অভ্যাসগত খাদ্যর মধ্যে রয়েছে প্রোটোজোয়া ১.২২ শতাংশ, এ্যলজি ৪১.৬৫ শতাংশ, ডায়াটম ১৫.৩৬ শতাংশ, ক্রাস্টাসিয়া ১.৮৯ শতাংশ। তবে সমুদ্র হতে ইলিশ যত উপরে উঠে আসে সে তত দু:খ-কষ্ট এবং জীবন ঝুঁকিতে পতিত হয়। সমুদ্র থেকে নদীর উজান মুখে যত এগিয়ে আসা যাবে তত কমবে খাবার, গভীরতা, স্রোত এবং তাপমাত্রা। যদিও প্রজনন ঋতুতে ইলিশ খাদ্য গ্রহণ করে না। ইলিশ  ৫০ ফুটের বেশি জল গভীরতা পছন্দ করে। ইলিশ যদি সমুদ্র হতে গোনাড বা পরিপক্কতায় পরিপূর্ন রূপ লাভ করে, তবে তা পূর্ণতা পায় তার জন্ম স্থান নদীর মিষ্টি জলে এসে। তবে নদীতে এসে ইলিশ মনোস্তাত্ত্বিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করে প্রজনন করতে। যদি সে ভালো পরিবেশ পায় তবে তার পেটে জমা এবং পরিপক্ক ডিমের ৬৫-৭০ শতাংশ পরিমাণ ডিম ছেড়ে দেয়। অবশিষ্ট ডিম অনেক সময় ৩-৫ মাসের ব্যবধানেও ছাড়তে পারে। ভাল পরিবেশ অব্যাহত থাকলে পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যেও দ্বিতীয় বার ডিম ছাড়তে পারে। ইলিশ বছরে ২-৩ বার ডিম দেয়।

আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন. পরিপক্ক মা ইলিশ বেশি ইলিশ উৎপাদনে অবদান রাখে। মা ইলিশ একবার ৫-২০ লাখ পর্যন্ত ডিম দিয়ে থাকে। তবে ডিম্বকোষের সকল ডিম একসাথে পরিপক্ক হয় না। পরিপক্ক ডিম ছেড়ে দেয়ার পর ডিম্বকোষে যে পরিমাণ অপরিপক্ক ডিম অবশিষ্ট থেকে যায় তা পরবর্তীতে হ্যাচ করে থাকে। এরপরেও যে ডিম অপরিপক্ক অবস্থায় ডিম্বকোষে থেকে যায় তা এক সময় মাছের শরীরে মিশে যায়। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এ কারণে মা ইলিশ তখন খাবার খাওয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। প্রজননের সময়ে ইলিশ তার গন্তব্যে যেতে তীব্র গতিতে মাইগ্রেট করে থাকে। তখন কিছু বাঁধার সন্মুখীন হয় বলে সে স¤পূর্ণ ডিম পরিপক্ক করে ছাড়তে পারেনা। উজানে আসতে গিয়ে বাঁধা পেয়ে থাকে বলে এই সময়ে ইলিশের গ্রোথ কমে যায়। তবে গ্রোথ না হলেও বয়সের ব্যবধানের কারণে তার গর্ভ ধারণ হয়। যে জন্য ফারাক্কার ভাটিতে নদী মোহনা পর্যন্ত এলাকায় পেটে ডিম ভর্তি ছোট ইলিশ পাওয়া যায়। ইলিশ মাছের ধর্ম হলো যেখানে সে জন্ম নেয়, সেখানে সে আবার জন্ম দিতে ফিরে আসে। প্রকৃত ঘটনা হলো ইলিশ যত বেশি সময় মিষ্টি জলে থাকবে, সে তত বেশি ফ্যাট প্রিজার্ভ করবে এবং ঐ মাছ তত বেশি সুস্বাদু হবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে দুই বছরের বেশি বয়সের ইলিশ সবচেয়ে বেশি পরিপক্ক ডিম দিয়ে থাকে। দিন দিন ইলশের ডিম্বকোষে ডিম ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। যা আমাদের ভাববার বিষয়। নদীর নব্যতা না থাকা, মিষ্টিজলে বর্জ বিষাক্ততা। নদীতে চাঁদরের মত বিছিয়ে রেখে অবৈধ জালে ইলিশ এবং জাটকা নিধন এই সমস্যা সৃষ্টির অন্যতম কারণ। মা ইলিশ সংরক্ষণের মাধ্যমে আমাদের ইলিশ সম্পদকে আরো সম্প্রসারণ করা গেলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক গতিশীলতা বেগবান করা যাবে। যে কারণে, পূর্ণিমার আগে ৩ দিন এবং আমাবস্যার পরে ৩-৫ দিন। পূর্ণিমার এবং অমাবস্যার মাঝখানে ১৫ দিনসহ মোট ২০-২৫ দিন এই সংরক্ষণ অভিযান অব্যাহত রাখা গেলে প্রায় ৭০-৬৫ শতাংশ  মা ইলিশের ডিম পরিপক্ক হয়ে জলে পাওয়া সম্ভব হবে। বিষয়টি মৎস্য অদিদপ্তর গুরুত্বের সাথে উপলদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। যে কারণে গেল ২০১৫ সন হতে মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান ১১ দিনের পরিবর্তে ১৫ এবং পরে ২০১৬ সন হতে ২২ দিন পালিত হয়েছে।এতে ইলিশের প্রজননে ডিমের পরিমাণ যেমন বেড়েছে আবার ইলিশ উৎপাদনও বেশি হয়েছে।

অভিযান সময় বাড়ানোতে মাছের অবাধ প্রজননসুবিধা বেড়েছে। উচ্চ বা বেশি পরিমাণে ডিম পাওয়া গেছে। একটি নির্দিষ্ট স্থানে বংশ পরস্পরায় ইলিশ মাছকে প্রজনন অভ্যস্তকরণ করা গেছে। ডিম থেকে জাটকা, জাটকা থেকে কিশোর ইলিশ। ভরপুর হয়েছে আমাদের ইলিশ সম্পদ। সবশেষে মৎস্য অধিদপ্তরকে অর্থাৎ সৈয়দ আরিফ আজাদ, মহাপরিচালক মহোদয় কে ধন্যবাদ। তিনি আমার মনের আকুতির বিষয়টি সময়যোগে উপলদ্ধি করে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। ইলিশ ব্যবস্থাপনায় লাভবান হচ্ছে আমাদের দেশের জেলেদের বিশাল একটা অংশ। জাতি আমিষজাতীয় খাদ্যের যোগান পাচ্ছে সহজে। আবার ইলিশ শক্তি যোগাচ্ছে আমাদের দেশের অর্থনীতির সামষ্টিক চাকায়।

লেখক: গবেষক, উদ্ভাবক, পরিবেশ ব্যক্তিত্ব।

This post has already been read 4920 times!