Tuesday 23rd of April 2024
Home / মৎস্য / শীতকালে মাছ চাষের সঠিক ব্যবস্থাপনা ও রোগ প্রতিরোধে করণীয়

শীতকালে মাছ চাষের সঠিক ব্যবস্থাপনা ও রোগ প্রতিরোধে করণীয়

Published at ডিসেম্বর ৮, ২০২০

কৃষিবিদ মো. রাশেদুজ্জজামান (দিপু) : শীতকালে সঠিক মাছ চাষ ব্যবস্থাপনা ও রোগ প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে মাছ চাষে সংশ্লিষ্ট সকল চাষিদের ভালোভাবে জেনে রাখা দরকার। মাছের চাষ ব্যবস্থাপনা ও রোগ প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে-

পৌষ-মাঘ এই সময়টা আমাদের দেশে শীতকাল, যেটা মাছ চাষীদের জন্য সংকটময় সময়। পৌষ মাসের শুরু থেকেই হালকা শীত পড়তে শুরু করে। এতে মাছের খাদ্য গ্রহণ অনেকটা কমিয়ে দেয়। এর প্রভাবে অতিরিক্ত খাদ্য পচে গিয়ে পুকুরে এ্যামোনিয়ার মাত্রা বৃদ্ধি পায়। এবং অভিস্রবণ প্রক্রিয়ার ফলে পানিতে প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয় এবং সর্বোপরি  মাছের মৃত্যু ঘটে।

আবদ্ধ পুকুরের ঠান্ডা পানিতে মাছ তাদের চলাচল কমিয়ে দেয়। যার ফলে মাছের মেটাবলিজম কমে যায় এবং ক্ষুধা কমে যায়, অন্যদিকে পানি ঠান্ডা থাকায় বিভিন্ন ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ে। দিন ছোট হওয়ায় রোদ অল্প সময় পুকুরের পানিতে পড়ে। ফলে পুকুরের পানির তাপমাত্রা কমে যায়।

পানির তাপমাত্রা কমার ফলে যে সমস্যাগুলো দেখা দেয়-

– সাধারণত তাপমাত্রা ২৮-৩২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হলে মাছের মেটাবোলিজম বা পরিপাক ভাল হয়। এর কম হলে পরিপাক ক্রিয়া কমে যাওয়ায় বৃদ্ধির হার কমে যায়।

– অন্যদিকে সুর্যের আলো কম পাওয়ায় প্রাকিতিক অক্সিজেন উৎপাদন কমে যায় ফলে মাছের শ্বাসকার্য চালাতে কষ্ট হয়। মাছ খাবি খেতে শুরু করে ফলশ্রুতিতে অক্সিজেনের অভাবে মাছের মৃত্যু ঘটে ।

– অপরদিকে পুকুরের পানিতে অবস্থিত ফাইটোপ্লাঙ্কটন তৈরির প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ায়  পানিতে দ্রবীভূত কার্বন ডাই অক্সাইডের (CO2) পরিমাণ বেড়ে যায়। এর ফলেও মাছের শ্বাস নিতে অসুবিধা হয়।

– প্রাকৃতিক খাদ্য কণা যেমন- ফাইটোপ্লাংটন বা উদ্ভিদকণা ও জুয়োপ্লাংটন বা প্রাণিকণা কমে যাওয়ায় মাছের খাবার স্বল্পতা দেখা দেয় ফলে দৈহিক বৃদ্ধি হ্রাস পায়।

– শীতকালে পানির পিএইচ (PH) স্বাভাবিক থাকে না। মাছের বৃদ্ধির জন্য স্বাভাবিক পিএইচের মান ৬-৮ এর মধ্যে থাকা উচিত। যদি ৬ এর থেকে কম হয়, তাহলে পানি বেশি অম্লীয় হয়ে যাবে এবং মাছ খাবার খেতে অনীহা দেখাবে। আবার ৮ এর থেকে বেশি হয়ে গেলে পানি ক্ষারীয় হবে এবং অতিরিক্ত ক্ষারত্তের ফলে মাছ মারা যেতে পারে।

– শীত মৌসুমে মাছে বিভিন্ন ধরনের যেমনঃ পরজীবী জনিত, ফাঙ্গাল জনিত এবং ব্যাকটেরিয়াল জনিত রোগ দেখা যায়।

এসময় সঠিকভাবে মাছের পরিচর্যা না করলে মাছের উকুন রোগ, অপুস্তিজনিত রোগ (মাছের চোখ অন্ধ হওয়া, হাড় বাঁকা) ,ক্ষতরোগ, লেজ ও পাখনা পচা রোগ, ফুলকা পচা রোগ এবং উদর ফোলা রোগ এসব রোগে আক্রান্ত হয়ে মাছ মরে যেতে পারে।

শীতকালীন সময়ে পুকুরের পরিচর্যা পদ্ধতি

– পুকুরের পাড়ের উঁচু গাছপালা যথাসম্ভব পরিষ্কার রাখতে হবে। যাতে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পুকুরে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পড়ে।

– কৃত্রিম উপায়ে পানিতে অক্সিজেনের বৃদ্ধি ঘটাতে হবে। জাল টেনে, সাঁতার দিয়ে এবং বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে পানিতে অক্সিজেনের বৃদ্ধি ঘটাতে হবে আর বড় পুকুর বা ঘের হলে কৃত্তিম অক্সিজেন ট্যাবলেট যেমনঃ এস আই অক্সিট্যাব ৪ থেকে ৫ কেজি প্রতি একরে সন্ধ্যা বেলায় প্রয়োগ করা যেতে পারে। প্রতি ১০-১৫ দিন অন্তর পুকুরে জাল টানলে স্বাস্থ্য, মাছের সংখ্যা ও ওজন সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যাবে। এছাডা জাল টানার ফলে পুকুরের তলদেশের বিভিন্ন ক্ষতিকারক গ্যাস বের হয়ে যাবে।

– ক্ষতিকর গ্যাস এমোনিয়া এর পরিমাণে মাছ মারা গেলে প্রয়োজনে এস আই এমোফ্রি-এল অথবা এস আই এমোফ্রী-পি প্রতি শতাংশে ৫ মিলি/গ্রাম সাথে ২০ মিলি করে চিটাগুর/মোলাসেস প্রয়োগ করতে হবে।

– অতিরিক্ত শেওলা, ময়লা-আবর্জনা, কচুরিপানা, আগাছাসহ সব ক্ষতিকর জলজ উদ্ভিদ পরিষ্কার করতে হবে।

– পুকুরের পানির পিএইচ ৬-৮ এর মধ্যে রাখতে  শীতের শুরুতে ১৫ থেকে ২০ দিন বা একমাস অন্তর অন্তর পুকুরে প্রতি একরে ৬-৭ কেজি এস আই বায়োজিও প্লাস প্রয়োগ করতে হবে। পিএইচ এর মান অতিরিক্ত বৃদ্ধি পেলে প্রতি একরে ২ লিটার ভিনেগার বা এসিডিন নামের এসিডিফায়ার প্রয়োগ করতে হবে। পিএইচ একেবারে কমে গেলে এস আই রয়েল জিও প্রতি একরে ১৫-২০ কজি প্রয়োগ করতে হবে।

– পুকুরে উদ্ভিদকণা বৃদ্ধির জন্য অজৈব সার বিশেষ করে ইউরিয়া (বিঘা প্রতি মাসে ৪-৫ কেজি)ও ট্রিপল সুপার ফসফেট (বিঘা প্রতি মাসে ৫-৬ কেজি) ৩ দিন ভিজিয়ে রেখে প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়াও এস আই ফাইটোগ্রো প্রতি একরে ৩-৪ লিটার কড়া রোদের সময় প্রয়োগ করা যেতে পারে।

– শীতের সময় মাছের সুষম বৃদ্ধি বজায় রাখতে মূল খাবারের মাছের হজমশক্তি বাডানোর জন্য প্রতি কেজি খাদ্যের সাথে উৎকৃষ্ট মানের উৎসেচক বা এনজাইম সমৃদ্ধ গ্রোথ প্রমোটর যেমনঃ এস আই গ্রোফিস প্রয়োগ করা উচিত। এতে মাছের খাবার চাহিদা বাড়বে। তার সাথে অবশ্যই একটা ভালো মানের ইমিউনোমডুলেটর জেলি যেমনঃ এস আই রয়েল জেল প্রতি কেজি খাদ্যের সাথে ১০ মিলি করে মিশিয়ে ১৫-২০ দিন টানা খাওয়াতে হবে।

– শীতে সাধারণত পুকুরের পানি কমে যায়। তাই প্রয়োজনমত পানি সরবরাহ করতে হবে। মাছের ঘনত্ব স্বাভাবিক বা কম রাখতে হবে। পুকুরের পানি বেশি দূষিত হলে পানি পরিবর্তন করতে হবে। প্রয়োজনে পানি দূষণ রোধে ভালো মানের দানাদার সয়েল পোবায়োটিক যেমনঃ এস আই প্রোক্লিন ৬-৮ গ্রাম করে সরাসরি পানিতে ছিটিয়ে দিতে হবে।

– প্রয়োজনে ভালো মানের জীবাণুনাশক (এস আই ক্লোর-টি) ১ টি করে ট্যাবলেট প্রতি শতাংশে এবং কপার সালফেট পেন্টাহাইড্রেট-১০% (এস আই ফাইটোক্লিন) ৩০ মিলি করে প্রতি শতাংশে প্রয়োগ করতে হবে।

– শীতের পুরো সময়ে পানির গুনগত মান ধরে রাখতে ১৫ দিন পর পর প্রতি একর পানিতে একটি উৎকৃষ্ট মানের ওয়াটার প্রোবায়োটিক যেমনঃ এস আই রয়েল প্রো ৫০০ গ্রাম এর সাথে ২ কেজি লাল চিনি পরিষ্কার পানির সাথে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।

বিশেষ প্রয়োজনে সংশ্লিস্ট মৎস্য বিশেষজ্ঞের সহায়তা নিন।

লেখক : এসিস্ট্যান্ট সেলস ম্যানেজার, ফার্মা এন্ড ফার্ম।

This post has already been read 7407 times!