Friday 29th of March 2024
Home / uncategorized / মাটি পরীক্ষার সুফল এবং মাটিতে খাবার লবণ প্রয়োগের কুফল

মাটি পরীক্ষার সুফল এবং মাটিতে খাবার লবণ প্রয়োগের কুফল

Published at মে ১৩, ২০২০

কৃষিবিদ মো. আব্দুল্লাহ-হিল-কাফি : বাংলাদেশে পরিবেশের বৈচিত্রতা আছে। পরিবেশের এই বিচিত্রতা শুধুমাত্র অঞ্চলভিত্তিক নয়, এর বিস্তৃতি উপজেলা এবং গ্রাম পর্যায়েও বিদ্যমান। ভূমির উত্তম ব্যবহার এবং কৃষির সঠিক পরিকল্পনার জন্য নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে ত্রিশটি (৩০) টি কৃষি পরিবেশ অঞ্চল এবং আটাশি (৮৮) টি উপ-অঞ্চল চিহ্নিত করা হয়েছে।  তাই মাটির পুষ্টি উপাদান সব জায়গায় এক রকম নয়। এ জন্য মাটি পরীক্ষা করে সার দেয়া উপকারি। আমাদের দেশের চাষাবাদ কৌশল, আবহাওয়া ও জলবায়ু এবং বিভিন্ন পারিপার্র্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করলে দেখা যায় আমাদের দেশের মাটিতে পুষ্টি উপাদান দিন দিন কমছে। আর এই অসুবিধা দুর করার জন্য পুষ্টির ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। সারের অপচয় রোধ তথা পুষ্টি উপাদানের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য মাটি পরীক্ষা করে সুষম মাত্রায় ফসলের চাহিদা ভিত্তিক সার প্রয়োগ করতে হবে সাথে সাথে গুড়া ইউরিয়া সারের বদলে গুটি ইউরিয়া সারের ব্যবহার করা প্রয়োজন। সুষম সার ব্যবহার বলতে বোঝায় মাটির র্উবরতা মান অনুসারে ও ফসলের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সার প্রয়োগ। গাছের পাতার রং দেখে সার দেয়া (এলসিসি ব্যবহার) এবং জমিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে জৈব সার প্রয়োগ করাও প্রয়োজন। সাথে ফসলের অবশিষ্টাংশ মাটিতে মেশানো, ডালজাতীয় ফসলের চাষ করা , সবুজ সার ফসলের চাষ ও জমিতে মেশানো, কিস্তিতে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা ইত্যাদি করা যেতে পারে।

মানুষ বেঁচে থাকার জন্য যেমন খাবার খাওয়া প্রয়োজন তেমনি সকল গাছের খাবারের প্রয়োজন হয়। গাছের জন্য যে সকল খাবারের প্রয়োজন হয় তার মধ্যে কিছু গাছ নিজেই তৈরি করতে পারে। বাকীগুলো মূলের সাহায্যে মাটি হতে গ্রহণ করে থাকে। কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন আলোর উপস্থিতিতে গাছ বায়ু হতে কার্বন-ডাই অক্সাইড সংগ্রহ করে পানির সাহায্যে খাদ্য তৈরি করে। ক্রমাগতহারে ফসল চাষ করার ফলে মাটি হতে গাছের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো আস্তে আস্তে কমে একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। যে কারণে ফসলের খাবার যোগান দেওয়ার জন্য জমিতে কৃত্রিম উপায়ে খাবার দেওয়া দরকার। কৃত্রিম উপায়ে গাছে যে সকল খাবার দেওয়া হয় তাকেই গাছের পুষ্টি উপাদান বলে। মাটিতে পুষ্টি উপাদান না দিলে গাছ পুষ্টি পাবে না ও ফসল ভাল হবেন। আর এতে গাছের বাড় বাড়তি কমে যাবে তেমনি বিভিন্ন রোগ ও পোকার আক্রমণ হবে। আর পুষ্টি উপাদান জমি থেকে  নিঃশেষ হয়ে গেলে পুষ্টি উপাদান পূরণ করা কঠিন হবে। আর ফসলে পুষ্টি ঘাটতি থাকলে তা মানুষ, পশু-পাখি সকলের পুষ্টি ঘাটতি হবে।

মাটি পরীক্ষার সুফল

মাটিতে পুষ্টি উপাদানের সঠিক অবস্থা জানা ফলে প্রয়োজন মাফিক সার সরবরাহ করা যায়। অধিক সার প্রয়োগে আর্থিক লোকসানের ঝুঁকি থাকে। আর কোন পুষ্টি উপাদান বেশি দিলে মাটিতে পুষ্টি উপাদানের ভারসাম্য বজায় থাকে না ফলে মাটির স্বাস্থ্য ভাল থাকে না। বেশি পরিমান রাসায়নিক সার দিলে  পরিবেশ দূষিত হয় এবং ফলনও কম হয়।

মাটির নমুনা এবং সংগ্রহে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি

মাটির নমুনা হলো কোন জমি হতে সংগৃহিত কিছু পরিমান মাটি যা ঐ জমির মাটির গুনাবলির প্রতিনিধিত্বি করে। সাধারনতঃ একখন্ড জমির র্কষণ স্তর বা উপরিস্তর থেকে সমদূরত্বে ৯ টি স্থান থেকে মাটির নমুনা সংগ্রহ করতে হবে। মাটির নমুনা সংগ্রহরে যে সমস্থ উপকরণ প্রয়োজন হয় তা হলো-কোদাল/খন্তা/নিড়ানী/বেলচা/অগার। এর সাথে প্লাস্টিকের বালতি/গামলা/ পলিথিন সীট লাগবে মাটি আনার জন্য। আর লাগবে মোটা পলিব্যাগ ও সূতলী  এবং লেবেল বা ট্যাগ।

জমি থেকে মাটির নমুনা সংগ্রহের নিয়ম

১. জমির চার সীমানা থেকে ২-৩ মিটার বা ৪-৬ হাত ভিতরে সমান্তরালভাবে সমদূরত্ব বজায় রেখে ৯ টি স্থান থেকে মাটির নমুনা সংগ্রহ করতে হবে।

২. রাস্তা বা বাঁধের পরিত্যক্ত ইটের ভাটা / নিকটবর্তী স্থান / সদ্য সার দেয়া জমি/গোবর বা কম্পোষ্ট / আবর্জনা স্তুপকৃত জায়গা/ফসলের নাড়া পোড়ানোর জায়গা থেকে মাটির নমুনা সংগ্রহ করা যাবে না। উল্লেখ্য যে, মাটির এরকম একটি খন্ড/প্লট হতেই নিতে হবে।

৩. একাধিক খন্ড/প্লটের মাটির নমুনা পরীক্ষা করাতে হলে প্রতি খন্ড জমি হতে আলাদাভাবে মাটির মিশ্র নমুনা সংগ্রহ করতে হবে।

৪. মাটি সংগ্রহের আগে জমির এক স্থানে গর্ত করে কর্ষণ স্তরের গভীরতা দেখে নিতে হবে। সাধারণতঃ রোপা ধানের জমিতে কর্ষণ স্তরের নীচে শক্ত ’কর্ষণ তল’ থাকে। তাই নমূনা সংগ্রহকালে কর্ষণ তল বাদ যাবে।

৫. কর্ষণ স্তরের গভীরতা জানার পর জমির আয়তনমত জমির ৯টি স্থান চিহ্নত করতে হবে।

৬. পরিষ্কার কোদাল বা খন্তা বা যে কোন খনন যন্ত্রের সাহায্যে কর্ষণ স্তরের গভীরতা পর্যন্ত আকৃতির গর্ত করতে হবে।

৭. গর্তের এক পাশ থেকে ৪ আঙ্গুল পরিমান পুরু মাটির চাকা তুলে চাকাটির দুই পাশ এবং কর্ষণ তলের অংশ (যদি থাকে) কেটে বাদ দিয়ে চাকাটি পলিথিন শীটের উপর কিংবা প্লাস্টিক বালতিতে রাখতে হবে।

৮. একই ভাবে ৯টি স্থান থেকে সংগৃহীত একই পরিমান মাটি বালতিতে রাখতে হবে।

৯. চাষ দেয়া জমি থেকে মাটি এমনভাবে নিতে হবে যাতে ঢেলাযুক্ত কিংবা গুড়ো কর্ষণ স্তরের সম্পূর্ণ অংশই সমপরিমানে সংগ্রহ করা হয়।

সংগৃহীত মাটির নমুনা ভালভাবে মিশ্রিতকরণ

১. পরিষ্কার পলিথিন শীট কিংবা বালতিতে রাখা সংগৃহীত মাটির নমুনার চাকাগুলো পরিষ্কার হাতে গুড়ো করে ভালভাবে মেশাতে হবে।

২. মেশানোর সময় মাটিতে ঘাস বা শিকড় থাকলে ফেলে দিতে হবে।

৩. মেশানো মাটি সমান চার ভাগ করে দু’কোন থেকে দু’ভাগ ফেলে দিতে হবে। বাকী দু’ভাগ মাটি আবার মিশিয়ে তা থেকে ৫০০-৭৫০ গ্রাম পরিমাণ গুড়ো মাটি পলিথিন ব্যাগে রাখতে হবে।

৪. মাটি ভেজা কিংবা আর্দ্র থাকলে ছায়াযুক্ত স্থানে শুকিয়ে নিতে হবে।

৫. ভেজা মাটির ক্ষেত্রে মাটির পরিমান এমনভাবে নিতে হবে যাতে শুকালে মাটি মোটামুটি ৫০০ গ্রাম থাকে।

৬. এই ৫০০ গ্রাম পরিমান মাটি পরীক্ষার জন্য সংশি¬ষ্ঠ উপ-সহকারী কৃষি অফিসারের মাধ্যমে ইউনিয়ন পর্যয়ে মাটি পরীক্ষা করাতে হবে অথবা উপজেলা কৃষি অফিসে মাটি পরীক্ষার নমুনা পাঠিয়ে মাটি পরীক্ষা করাতে হবে।

মাটি পরীক্ষা কোথায় করা যায়

সরকারী ও বেসরকারী প্রায় ৬টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মাটি পরীক্ষা করে সার সুপারিশ প্রদান করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনষ্টিটিউটের ঢাকা প্রধান অফিস সহ সকল আঞ্চলিক অফিসসমূহ, ব্র্যাক, প্রশিকা, জিকেএফ এবং বিএফএ। এছাড়া মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনষ্টিটিউটের ভ্রাম্যমান মৃত্তিকা পরীক্ষাগার রয়েছে।

লবণ প্রয়োগরে কুফল

ফসলের অধিক ফলনের আশায় অন্যান্য সার ব্যাবহারের পাশাপাশি জমিতে খাওয়ার লবণ প্রয়োগ করা মোটেও ঠিক নয়। যা ফসল উৎপাদনে কোন উপকার করে না বরং মারাত্মক ক্ষতি করে। খাওয়ার লবণ সোডিয়াম এবং ক্লোরিন দ্বারা গঠিত মাটিতে এগুলির পরিমান বেড়ে গেলে মাটিতে বিষাক্ততা দেখা দেয়। খাওয়ার লবণ জমিতে দিলে সাময়িক কিছু ভাল ফলাফল দেখা গেলেও তা জমির ফসল উৎপাদন ক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং জমিকে অনুর্বর করে তোলে। মাটিতে খাওয়ার লবণ প্রয়োগ করলে যে সকল ক্ষতি হয় তা হলো-

১. মাটিতে পর্যাপ্ত পুষ্টি উপাদান থাকলেও গাছ তা ব্যবহার করতে পারেনা। এটি গাছের জন্য অত্যবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদান ফসফরাস ও পটাশিয়ামকে গাছের ব্যবহার উপযোগি হতে দেয় না। অথ্যাৎ আমরা টি,এস,পি বা ডিএপি সার বা এমওপি সার ব্যবহার করলেও লবণ প্রয়োগের জন্য কোন উপকার পাওয়া যাবে না।

২. এছাড়া একটু লক্ষ্য করলেই আমরা বুঝতে পারি। সমুদ্রের পানি হচ্ছে লবনাক্ত এটি থেকেই আমরা খাওয়ার লবণ পাই। এই পানির কারণে খুলনা, নোয়খালি ,পটুয়াখালি, বরিশাল, বরগুনা জেলার মাঠ ফসলের উৎপাদন উত্তোরাঞ্চলের অঞ্চলের থেকে কম। অর্থাৎ লবনাক্ততা মাটির ,উর্বরতা কমিয়ে দেয় আর আমরা যদি এই লবণ মাটিতে প্রয়োগ করি তবে আমাদের মাটিও লবনাক্ত হবে এবং ফসল উৎপাদন কমিয়ে দিবে।

৩. এছাড়াও গাছ মাটি থেকে পানি গ্রহণ করতে পারবেনা কারণ লবনের সোডিয়াম ও ক্লোরিন  গাছের পানি নেয়ার প্রক্রিয়া অর্থাৎ অভিশ্রবণ প্রক্রিয়াকে বাধা দেয়। ফলে গাছ দুর্বল হয়ে ফসল কম হবে ।

৪. খাওয়ার লবনের কারনে কচি শিকড়ের মুখ পুড়ে যায়। কারণ লবণ মাটিতে ক্ষারীয় অবস্থা সৃষ্টি করে। আর এই কারনে শিকড় দিয়ে গাছ পুষ্টি নিতে পারেনা ফলে গাছের রোগ সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া কচি শিকড়ের মুখ পুড়ে যাওয়ার কারনে গাছের শিকড়ের বিস্তার কমে যায় এবং গাছ হলুদ হয়ে যায়।

৫. মাটির উপকারী অনুজীব নষ্ট হয়, যার ফলে মাটি তার স্বাভাবিক কাজ করতে পারে না।

৬. খাওয়ার লবনের কারনে গাছের ভিতরের প্রয়োজনীয় রস শিকড় দিয়ে মাটিতে চলে যায়। ফলে গাছ দুর্বল হয়ে মারা যায়। কারণ লবণ প্রয়োগ করলে গাছের মধ্যেকার রসের ঘনত্বের চেয়ে মাটির মধ্যকার পানির ঘনত্ব বেড়ে যায় ফলে গাছের রস মাটির পানিতে চলে আসে।

৭. লবণ প্রয়োগ করলে ইউরিয়া সার,টি,এস,পি,সার দস্তা সার প্রয়োগ করলেও কাংখিত ফলাফল পাওয়া যাবে না।

৮. বীজের অংকুররোদগম ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। ফলে উৎপাদন ও ফলন উভয়ে কমে যায়।

৯. এছাড়া খাওয়ার লবণ প্রয়োগের কারনে মাটির গঠন ভেঙ্গে যায়। এবং সঠিক মাত্রায় মাটিতে পানিও বাতাস থাকতে পারেনা। আর পানি ও বাতাস পরিমান মত না থাকলে গাছের শিকড় সঠিক ভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারেনা, ফলে গাছ সহজে পানি গ্রহণ করতে পারেনা।

১০. মাটির গঠন ভেঙ্গে গেলে মাটি শক্ত হয়ে যায় এবং উৎপাদন বিকল্প প্রভাব সবচেয়ে মারাক্ত অসুবিধা হচ্ছে প্রথমে লবণ ছোলা প্রয়োগ করলে পটাশ সারের গ্রহণ বৃদ্বি পায় কিন্তু পরবীর্তে কমতে কমতে এমন পর্যায়ে যায় যে সার প্রয়োগ করলে ও আর গাছ গ্রহণ করতে পারে না।

মাটি গাছের পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে যা গাছের জন্য অপরহার্য। কিন্তু বাংলাদেশের মাটিতে ১৯৫১ সাল হতে নাইট্রোজেন, ১৯৫৭ সাল হতে ফসফরাস, ১৯৬০ হতে পটাশিয়াম, ১৯৮০ সাল হতে সালফার, ১৯৮২ সাল হতে দস্তা (জিংক), ১৯৯৫ সাল হতে বোরন এবং ২০০০ সাল হতে ম্যাগনেশিয়াম এবং মলবডিনিয়ামের অভাব পরীলক্ষিত হচ্ছে।  গাছে ১৬টি পুষ্টি উপাদানরে মধ্যে ১৩টি মাটি থেকে আসে। দীর্ঘদিন শস্য উৎপাদনের ফলে মাটির পুষ্টি উপাদানের পরিমান আর আগের অবস্থায় নেই। এমতাবস্থায় মাটির স্বাস্থ্যের জন্য মাটি পরীক্ষা করা এবং জমিতে লবণ প্রয়োগ না করা একান্ত প্রয়োজন।

লেখক: আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, রাজশাহী।

This post has already been read 2472 times!