Thursday 25th of April 2024
Home / মতামত / বৈশ্বিক উষ্ণতা, প্রাণিসম্পদ ও বাংলাদেশ

বৈশ্বিক উষ্ণতা, প্রাণিসম্পদ ও বাংলাদেশ

Published at সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৯

প্রফেসর ড. সৈয়দ মোহাম্মদ এহসানুর রহমান ও মো.  আবীর হাসান : বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হল বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তন। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে অনেক দেশই আজ মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন। জাতিসংঘের পরিবেশবাদী সংস্থা (IPCC 2007) এর  মতে, ২১০০ সাল  এর  মধ্যে  বিশ্বের  তাপমাত্রা  বর্তমান  সময়ের  চেয়ে ১.৪ থেকে ৫.৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত  বাড়তে  পারে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ক্ষতিগ্রস্থতার বিচারে বিশ্বব্যাপী গবেষকগণ বাংলাদেশকে পোস্টার চাইল্ড (Poster Child) হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকেন।

জাতিসংঘের আন্তসরকার জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যানেল-এর তথ্যমতে, ২০৫০ খ্রিস্টাব্দে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের অন্তত ১৭% ভূমি সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যাবে ৷ ‘দ্যা সায়েন্টিফিক কমিটি অন এন্টার্কটিক রিসার্চ’ (SCAIR) জানিয়েছে, যে হারে এন্টার্কটিকার বরফ গলছে তাতে ২১০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে ৫ ফুট। বিগত দিনের পরিসংখ্যানের প্রায় দ্বিগুণ এই হিসাবের প্রেক্ষিতে ব্রিটেনের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা DFDI এ পরিমাণ উচ্চতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের প্রায় এক পঞ্চমাংশ সমুদ্রে তলিয়ে যাবার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।

বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত তালিকায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে ঝুঁকিপূর্ণ ১২টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দশম। এ রকম অকষ্মাৎ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে ২০৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ দেশের প্রায় ৮%-এরও বেশি নিম্নাঞ্চল ও প্লাবনভূমি আংশিক এবং/অথবা স্থায়ীভাবে জলমগ্ন হয়ে পড়বে। এছাড়া ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড বা WWF-এর মতে, সমৃদ্রস্তরের উচ্চতাবৃদ্ধিতে ঢাকাও আক্রান্ত হতে পারে। এইসব ভবিষ্যত সংশ্লিষ্টতার প্রেক্ষিত পেরিয়ে বর্তমানেই (২০০৯) সুন্দরবনে সর্বপ্রথম, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি অনুভূত হয়। কারণ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের  সমুদ্রবিজ্ঞানীদের দেয়া তথ্যমতে, ২০০০ খ্রিস্টাব্দের আগ পর্যন্ত সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর ৩ মিলিমিটার (০.১২ ইঞ্চি) করে বাড়ছিল, কিন্তু পরবর্তি দশকেই প্রতি বছর ৫ মিলিমিটার (০.২ ইঞ্চি) করে বাড়া শুরু হয়েছে ।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির অনেকগুলো কারণসমূহের মধ্যে প্রাণিসম্পদের ও অবদান আছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্যমতে, সারাবিশ্বের প্রাণিসম্পদ (গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ) ১৮% গ্রীণহাউজ গ্যাস নিঃসরণের জন্য দায়ী। বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ২০ বিলিয়ন প্রাণি আছে যারা বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা প্রদান করার পাশাপাশি প্রতিবছর প্রায় ৬ বিলিয়ন টন গ্রীণহাউজ গ্যাস উৎপন্ন করছে । প্রায় ১.৬- ২.৭ বিলিয়ন টন গ্রীণহাউজ গ্যাস (বেশিরভাগই মিথেন গ্যাস) প্রাণিসম্পদের খাবার এর পরিপাক -এর সময় উৎপন্ন হয়। বাকি ১.৩- ২.০ বিলিয়ন টন নাইট্রাস অক্সাইড গ্যাস খাদ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরনের সময় এবং ১.৬ বিলিয়ন টন গ্রীনহাউজ গ্যাস খাদ্য উৎপাদন করার জন্য জমি ব্যবহার করার সময় উৎপন্ন হয় (ইন্টারনেট সূত্র: To reduce greenhouse gases from cows and sheep, we need to look at the big picture) ।

একটি গরু প্রতিবছর গড়ে ৭০-১২০ কিলোগ্রাম মিথেন গ্যাস উৎপন্ন করে এবং এই মিথেন গ্যাসের জলবায়ুর উপর নেতিবাচক প্রভাব কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসের চেয়ে প্রায় ২৩ গুণ বেশি (ইন্টারনেট সূত্রঃ Are cows the cause of global warming? | Time for change ) । বর্তমানে বাংলাদেশে গবাদিপশুর সংখ্যা প্রায় ২৫.৭ মিলিয়ন এবং এই ২৫.৭ মিলিয়ন গবাদিপশু বছরে প্রায় ১৭,৯৯,০০০- ৩,০৮৪,০০০ মেট্রিক টন মিথেন গ্যাস উৎপন্ন করে।

বিজ্ঞানীদের মতে প্রাণিসম্পদ হতে প্রতি বছর উৎপন্ন গ্রীনহাউজ গ্যাসের মধ্যে প্রায় ২.৪ বিলিয়ন টন গ্যাস নিঃসরন কমানো সম্ভব উন্নত প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে। যেমন- প্রাণিদের খাদ্যাভাসে পরিবর্তন (ভালো মানের খাবার সরবরাহ, চারণভূমির ব্যবস্থা করা, দানাদার খাদ্য সরবরাহ করা) আনতে হবে, প্রাণি বর্জ্য (গোবর) ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি উন্নত করতে হবে এবং আধুনিক উপায়ে প্রাণিদের লালন পালন করতে হবে।

গবাদিপশুকে কোন ধরনের খাবার খাওয়ানো হচ্ছে তার ওপর অনেকাংশেই নির্ভর করে গবাদিপশু কর্তৃক মিথেন গ্যাস উৎপন্নের হার। নিম্নমানের খাবার সরবরাহ অতিরিক্ত মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হওয়ার প্রধান কারণ। গবাদিপশুকে দানাদার জাতীয় খাবার সরবরাহ করতে হবে, দানাদার জাতীয় খাবার খাওয়ালে গবাদিপশুর শরীরে প্রোপায়নিক এসিড উৎপন্নের হার বেড়ে যাবে এবং মিথেন গ্যাস উৎপন্নের হার কমে যাবে।

গবেষণায় দেখা গেছে, যদি গবাদিপশুর খাবারে দানাদার জাতীয় খাবার এর পরিমাণ বাড়ানো যায় তাহলে মিথেন গ্যাস উৎপন্নের হার প্রায় ২০-৩২% হ্রাস পায় (Singh 1998) । আমাদের দেশের স্থানীয় গরুর জাতসমুহকে জেনেটিক্স এর জ্ঞান প্রয়োগের মাধ্যমে অধিক দুধ উৎপন্নকারী জাতে পরিণত করতে হবে এবং এই প্রক্রিয়াটি বর্তমানে বাংলাদেশে চলমান রয়েছে। গরুর গোবর থেকে যে গ্যাস উৎপন্ন হয় তাতে প্রায় ৫৫-৬৫% মিথেন,৩০-৩৫% কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস থাকে (Mishra and Mandal 2010)। বায়োগ্যাস প্লান্টের মাধ্যমে আমরা গরুর গোবরকে শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহার করতে পারি মিথেন গ্যাস উৎপন্ন করার মাধ্যমে,যা আমাদের দেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

বিশ্বের উন্নত দেশসমুহে গবাদিপশু হতে কিভাবে গ্রীণহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমানো যায় তা নিয়ে অনেক বছর ধরেই গবেষণা চলে আসছে এবং এই বিষয়ে আমাদের দেশেও কার্যকরী গবেষণা হওয়া দরকার। পাশাপাশি আমাদের দেশে যারা গবাদিপশু লালন পালন করে তাদের গবাদিপশু কর্তৃক গ্রীণহাউজ গ্যাস নিঃসরণ সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। কারণ, আমাদের দেশে যারা গবাদিপশু লালন পালন করেন তাদের অনেকেই এই বিষয়ে অবগত নয়।

বর্তমানে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে এবং মানুষ এখন তাদের প্রতিদিনের আমিষের চাহিদা পুরণ করার জন্য আগের যেকোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। জনসাধারণের এই আমিষের চাহিদা পুরনে বাংলাদেশে প্রাণিসম্পদের পরিমান দিন দিন বেড়ে চলেছে, যা খুবই আশাব্যাঞ্জক এবং এর জন্য বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পশুপালন অনুষদের গ্রাজুয়েটদের গুরত্ব অনস্বীকার্য।

আমি আশা করি বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদের উন্নয়নের পাশাপাশি গবেষণার মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ হতে মিথেন গ্যাস নিঃসরণ কমানোর উপায় খুজে বের করে আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্বের বৈশ্বিক উষ্ণতা কমিয়ে আনতে পশুপালন অনুষদের গ্রাজুয়েটবৃন্দ বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করবে। গ্রীণহাউজ গ্যাস নিঃসরনের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত যেহেতু আমরাই হচ্ছি সেহেতু এই সমস্যা সমাধানে আমাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। তাই আসুন আমরা সবাই যার যার অবস্থান থেকে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সচেষ্ট হই এবং এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে রক্ষা করি আমাদের প্রাণপ্রিয় সবুজ শ্যামলে ভরা বাংলাদেশকে তথা সমগ্র পৃথিবীকে।

লেখক: পশুবিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।

This post has already been read 3503 times!