Friday 29th of March 2024
Home / মৎস্য / বিষ প্রয়োগে মাছ শিকারে হুমকির মুখে সুন্দরবনের মৎস্য ভান্ডার 

বিষ প্রয়োগে মাছ শিকারে হুমকির মুখে সুন্দরবনের মৎস্য ভান্ডার 

Published at আগস্ট ১৫, ২০২০

ফকির শহিদুল ইসলাম(খুলনা) : বিশ্বখ্যাত ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট সুন্দরবনের মৎস্য ভান্ডার এখন হুমকির সম্মুখীন। আমিষের চাহিদা পূরণের অফুরন্ত এ মৎস্য ভান্ডারের রক্ষনাবেক্ষণ এখন সময়ের দাবি। বন বিভাগের পর্যাপ্ত সাপোর্ট, জলযানের অভাব, সোর্স মানি ও ঝুঁকি ভাতা না থাকায় সুন্দরবনের অভ্যন্তরে ও অভয়ারণ্যে কীটনাশক দিয়ে মাছ শিকার কোনভাবেই যেন ঠেকানো যাচ্ছে না। মাছ ধরার এই সর্বনাশা প্রক্রিয়া বেশ কয়েক বছর ধরে চলে আসলেও লোকবলের অভাব ও বনবিভাগের উদাসীনতার কারণে এ অপরাধ দমন করা সম্ভব হচ্ছে না। কয়েক মাস ধরে বনবিভাগ, কোস্ট গার্ড ও পুলিশের অভিযানে সুন্দরবনের নদী খালে বিষ প্রয়োগে মাছ শিকাররত জেলেদের কাছ থেকে বিষের বোতল ও বিষ দিয়ে ধৃত চিংড়ি মাছ সহ ২৮ জন জেলে আটক করে জেল জরিমানা করা হয়েছে। অভিযানকালে ২০টি নিষিদ্ধ ভেষালি জাল ও মাছ ধরার অন্যান্য সরঞ্জাম উদ্ধার করে র‌্যাব পুলিশ। বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান চলমান রয়েছে তারপরও থামছে না অসাধু জেলেদের বিষ দিয়ে মাছ শিকার করার প্রবণতা। বিষক্রিয়ায় বিশ্বখ্যাত ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট সুন্দরবনের মৎস্য ভান্ডার আজ হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে।

সূত্রমতে গত একযুগের বেশি সময় ধরে সুন্দরবনের অভয়ারণ্য এলাকায় বিষ প্রয়োগ করে মাছ শিকার ব্যপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী ও খালে অবৈধভাবে পোনা মাছ নিধন যজ্ঞে মেতে উঠেছেন এক শ্রেণির অসাধু জেলেদের একাধিক চক্র। অভিযোগ উঠেছে, অর্থ বাণিজ্যের মাধ্যমে অসাধু জেলেদের এমন অনৈতিক কাজে সহায়তা করছেন বনবিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারী।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলে ও স্থানীয়রা বলেন, বনবিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী, রাজনৈতিক গডফাদার, আর মহাজন নামক দাদন (কোম্পানী) ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে কোনক্রমে ঠেকানো যাচ্ছে না এই সর্বনাশা মৎস্য শিকার। সিন্ডিকেট চক্র ভাগাভাগি করে লুটে নিচ্ছে মাসে লাখ লাখ টাকা।

এক্ষেত্রে অসাধু বন কর্মকর্তা-কর্মচারী লুটের মাসোয়ারা ভাগ বাটোয়ারা করে পকেটস্থ করছে। আর বনবিভাগের পদস্থ কর্মকর্তারা ধোয়া তুলশী পাতার মত ছাফাই গেয়ে চলেছেন। তাদের বক্তব্য পর্যাপ্ত সাপোর্ট, নৌযানের অভাব, সোর্স মানি ও ঝুঁকি ভাতা না থাকায় এবং সর্বপোরি মাষ্টার প্লানের অভাবে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে ও অভয়ারন্যে বিষ দিয়ে মাছ শিকার বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ বিষয়ে কথা হয় মানবাধিকার কর্মী ও পরিবেশবাদীদের সাথে। তারা জানিয়েছেন বনবিভাগের উদাসীনতার কারণে এ অপরাধ দমন করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষক্রিয়ায় প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার মাছ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ধ্বংসের পাশাপাশি মৎস্য প্রজনন চরমভাবে বাধাগ্রস্থ সহ অভ্যন্তরীন মৎস্য ভান্ডার শুন্য হচ্ছে। সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব। আর সাধারন মানুষ খাচ্ছে বিষাক্ত খাবার অনুপযোগী মাছ। আমিষের চাহিদা পূরণের অফুরন্ত এই মৎস্য ভান্ডারের রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব মৎস্য ও প্রানী সম্পদ মন্ত্রনালয়ের অধিন নেয়া এখন সময়ের দাবি।

বন বিভাগের সূত্রমতে, ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট সুন্দরবনের স্থলভাগের পরিমান ৪ হাজার ১৪৩ বর্গকিলোমিটার ও জলভাগের পরিমানে ২ হাজার ৮৭৪ বর্গ কিলোমিটার । সুন্দরবন বন বিভাগ পূর্ব ও পশ্চিম এ দুভাগে বিভক্ত। দু’বিভাগে মোট ৪টি রেঞ্জ ও ১৬টি ষ্টেশন রয়েছে। সুন্দরবনের মধ্যে ৪ শতাধিক খাল ও ভারানি আছে। এ সকল খাল ও নদী পরিদর্শন করার জন্য ৭৬টি ফরেষ্ট ক্যাম্প ও ১৭৮ জন বন প্রহরী রয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম। সুন্দরবন রক্ষনাবেক্ষনের জন্য পর্যাপ্ত লোকবল ও সরাঞ্জামাদি নেই। তবে বর্তমানে কোষ্টগার্ড, পুলিশ ও র‌্যাব সুন্দরবন সুরক্ষায় বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। আর তাতেও আবার গাত্রদাহ বনবিভাগের। অসংখ্য নদী নালা ও খাল দ্বারা বেষ্টিত সুন্দরবন পূর্ব ও পশ্চিম বিভাগের কয়েকটি এলাকা অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলো হচ্ছে পূর্ব বনবিভাগের নীলকমল, হিরন পয়েন্ট, কটকা, কচিখালী এলাকার অংশ বিশেষ। জানা গেছে কয়রা এলাকার কয়েকটি মাছ কোম্পানী চক্র বনবিভাগের সাথে যোগসাজশে জেলেদের কাছ থেকে প্রতি গোনে নির্দিষ্ট মাসোয়ারা আদায় করছে। এই চক্রটি চোরা মাছ শিকারীদেরকে অভয়ারণ্যে মাছ ধরার সুযোগ করে দেয়ায় মাছের প্রজনন আশংকাজনক হারে কমে যাচ্ছে। এছাড়া পশ্চিম বনবিভাগের ঝাপসি, ভদ্রা, হাডড়া, চালুবগী, নিষেনখালী, সাহেবখালী, বোটবুড়নিয়া, পাটকোষ্টা, হংশরাজ, পাঠাঘাঠা, ভোমরখালী, আড়–য়া শিবসা, সাচানাংলা সহ প্রভৃতি স্থানের বিভিন্ন খাল ও নদ-নদীতে বিষ প্রয়োগে অবাধে মাছ শিকার হচ্ছে। বিষ প্রয়োগে ধরা এসব মাছ যাচ্ছে শহরের বিভিন্ন আড়তে। এতে মৃত্যুঝুঁকির আশঙ্কা বাড়ছে। এভাবে মাছ ধরায় মৎস্য সম্পদ ধ্বংসের পাশাপাশি অসংখ্য সাধারণ জেলের জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে। স্থানীয় কয়েকজন জেলে জানায়, আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন সুন্দরবনে বিষ প্রয়োগে মাছ ধরা বেড়েছে। কীটনাশকে ধ্বংস হচ্ছে বনজ সম্পদ। বিষ ক্রিয়ায় মারা যাওয়া এসব মাছ খেলে হতে পারে জীবনঘাতী রোগ।

সুন্দরবনের কোলঘেঁষে বসবাস বিপুলসংখ্যক মানুষ জীবিকার জন্য মাছ ধরা, গোলপাতা ও মধু আহরণসহ নানাভাবে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। সম্প্রতি কতিপয় অসাধু মাছ শিকারি স্থানীয় টহল ফাঁড়ির বন কর্মচারীদের সঙ্গে আঁতাতের মাধ্যমে পশ্চিম সুন্দরবনের আওতায় বিভিন্ন খালে বিষ প্রয়োগে অবাধে মাছ চলছে পুরোদমে। এসব এলাকার মধ্যে বেশকিছু নদী ও খাল অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এখানে প্রজনননের কারণে মাছ ধরা সম্পূর্ন নিষিদ্ধ। কিন্তু অসাধু মৎস্য শিকারীরা সুন্দরবনে বিভিন্ন খাল ও নদ নদীতে বিষ প্রয়োগ করে অবাধে নানা প্রজাতির মাছ শিকারের নামে সর্বনাশা কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়রার এক জেলে বলেন, আমরা অনুমতি নিয়ে মাছ ধরতে যাই। কিন্তু অনেক জেলে আছে যারা অনুমতি না নিয়ে বন বিভাগের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীকে টাকা দিয়ে পানিতে বিষ ঢেলে মাছ ধরে। এতে করে একদিকে যেমন বনের গহীনে থাকা বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও মাছের পোনা ধ্বংস হচ্ছে অন্যদিকে বিষ প্রয়োগ করে শিকার করা মাছ খেয়ে মানুষ পেটের পীড়াসহ নানান জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এ ছাড়া বিষ প্রয়োগকৃত পানি পান করে বাঘ, হরিণসহ বনের নানা প্রাণীও বিভিন্নভাবে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছে। বন বিভাগ মাঝে মধ্যে এসব মৎস্য দস্যুদের আটক করলেও বিষ প্রয়োগ করে মাছ শিকার কোন ভাবেই রোধ হচ্ছে না।

দাকোপ উপজেলার সুতারখালী-কালাবগী গ্রামের বাসিন্দা মৎস্যজীবী ফারুক হোসেন গাজী (৩২) বলেন, বিষ দিয়ে মাছ মারার পরে ওই খালে অনেক দিন ধরে কোনো মাছ ঢোকে না। কারণ, খালে মাছের কোনো খাবারও থাকে না। অনেক সময় আমরা পাশ নিয়ে খালে গিয়েও মাছ না পায়ে খালি হাতে ফিরেছি। এখন যা অবস্থা তাতে অসাধু মাছ শিকারিদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের কঠোর ব্যবস্থা নেয়া দরকার। তা না নিলে সুন্দরবনের নদী ও খালের মাছ ধ্বংস হয়ে যাবে।

পশ্চিম সুন্দরবনের সুতারখালী বনবিভাগ কার্যালয় সূত্রমতে, সুন্দরবনে কীটনাশক দিয়ে মাছ শিকার বন্ধে এবং ডলফিনের অভয়ারণ্য সংরক্ষণসহ বনকেন্দ্রীক অপরাধ দমনে ১ জুলাই থেকে ৩০ আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনের সব খালে মাছ আহরণে নিষেধাজ্ঞা জারি করে বনবিভাগ। তবে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে অল্প পরিশ্রমে অধিক মুনাফার আশায় অসাধু মাছ শিকারিরা বিভিন্ন কীটনাশক সঙ্গে নিয়ে বনে মাছ ধরতে যায়। জোয়ার আসার কিছু সময় আগে ওই কীটনাশক চিড়া, ভাত বা অন্য কিছুর সঙ্গে মিশিয়ে নদ-নদী ও খালের পানিতে ছিটিয়ে দেয়। ফলে ওই এলাকার বিভিন্ন প্রজাতির মাছ মরে ভেসে ওঠে।

সুতারখালী গ্রামের মৎস্য ব্যবসায়ী রোকনুজ্জামান মল্লিক বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চল সুতারখালী এলাকার ৮০ ভাগ লোকই সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে কিছু জেলে সুন্দরবনে গিয়ে বিষ দিয়ে মাছ মারছে। ফলে সাধারণ জেলেরা মাছ পাচ্ছে না। তারা চরম বিপদে পড়েছে, সেই সঙ্গে আমাদের ব্যবসাও লাটে উঠেছে।

দাকোপ উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা সেলিম সুলতান বলেন, নদী ও খালে বিষ প্রয়োগে মাছ শিকার সম্পূর্ণ অবৈধ। সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ মারার কথা শুনছি। অনেক সময় নৌপুলিশ ও বনবিভাগ অভিযান চালিয়ে ওইসব মাছ শিকারিদের আটক করে। তিনি আরও বলেন, বিষ দিলে মাছের সঙ্গে সব প্রজাতির জলজ প্রাণীই মারা যায়। এটা জীববৈচিত্র্যের জন্য খুবই মারাত্মক। পরিবেশের ওপর যেমন বিরূপ প্রভাব পড়ে অন্যদিকে বিষে মরা ওই মাছ খেয়ে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণী।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির খুলনার সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান মুকুল বলেন, বিষ প্রয়োগে মাছ শিকার বন্ধে অভিযান জোরদার করতে হবে। আমাদেরকে সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার স্বার্থে দেশের এই শত্রুদের বিরুদ্ধে বন বিভাগকে আরো কঠোর হতে হবে। তিনি বলেন, সুন্দরবন, সুন্দরবনের প্রাণি ও মৎস্য সম্পদ রক্ষায় সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য বন ও পরিবেশ অধিদপ্তর, মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ অধিদপ্তরকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পশ্চিম সুন্দরবন বিভাগের খুলনা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক মোঃ আবু সালেহ বলেন, বিষ প্রয়োগ করে মাছ শিকারের দায়ে বন বিভাগ অভিযান চালিয়ে ২৮ জন আটক করে আইনে সোপর্দ করেছে। এ সময় ৫শ কেজি চিংড়ি মাছ জব্দ করা হয়। এ কাজে বন বিভাগের লোক জড়িত কি না, তা খোঁজখবর নিয়ে দেখা হবে। অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে তিনি জানান।

This post has already been read 1704 times!