Tuesday 19th of March 2024
Home / মৎস্য / বায়োফ্লক পদ্ধতিতে ট্যাংক ও পুকুরে মাছ চাষে pH এর গুরুত্ব ও প্রভাব

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে ট্যাংক ও পুকুরে মাছ চাষে pH এর গুরুত্ব ও প্রভাব

Published at ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২০

সালাহ উদ্দিন সরকার তপন : মাছ চাষে পি.এইচ (pH) এর প্রভাব সবচাইতে বেশি, বায়োফ্লকের মূল আলোচনা শুরুর আগে পানির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পি.এইচ সম্পর্কে আলোচনা করা দরকার,

pH বলতে কি বুঝায়?

রসায়নে পি.এইচ (ইংরেজি: pH) হচ্ছে দ্রবীভূত হাইড্রোজেন আয়নের সক্রিয়তার পরিমাপ। পি.এইচ দ্বারা মূলত হাইড্রজেন আয়নের ঘনত্ব বোঝায়। অম্ল ও ক্ষারের জলীয় দ্রবণে হাইড্রোজেন আয়নের ঘনমাত্রা প্রকাশের জন্য pH স্কেল নামক একটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। দ্রবণে হাইড্রোজেন আয়নের ঘনমাত্রা বুঝাবার জন্য ব্যবহৃত সংকেত পি.এইচ (pH)। ফরাসি শব্দ Pouvior Hydrogene অর্থাৎ হাইড্রোজেন শক্তি, সংক্ষেপে pH। পি.এইচ-এর স্কেল ০ থেকে ১৪ পর্যন্ত বিস্তৃত। সংক্ষেপে যদি বলি তাহলে বলব ” এসিড এবং ক্ষারের পরিমাপ কে pH বলা হয়”।

২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বিশুদ্ধ পানির পি.এইচ ৭, যাকে পি.এইচ স্কেলের নিরপেক্ষ মান হিসেবে ধরা হয়। পানি বিক্রিয়ক বিশেষে কখনো অম্ল আবার কখনো ক্ষারকের মত আচরণ করে এজন্য পানিকে AmorpHous বা, অনিয়তাকার ( নির্দিষ্ট আকার বিহীন) পদার্থ বলা হয়ে থাকে। পি.এইচ স্কেলে নিরপেক্ষ পানির পি.এইচ কে মধ্যমান ধরে যাদের পি.এইচ ৭ এর নিচে তাদের অম্ল এবং যাদের পি.এইচ ৭ এর ওপরে তাদের ক্ষারক বলা হয়। মাছ ও চিংড়ী চাষে পানির আদর্শ পি এইচ ধরা হয় ৭.৫ – ৮.৫। জলীয় দ্রবণের পি.এইচ মাপার জন্য পি.এইচ নির্দেশক, গ্লাস-ইলেকট্রড অথবা পি.এইচ মিটার ব্যবহার করা হয়।

জীববিজ্ঞান, রসায়ন, কৃষিবিজ্ঞান, বনবিদ্যা, পরিবেশ বিজ্ঞান, ফরেনসিক,নখাবারের মান যাচাই, গবেষণাগারের বিভিন্ন পরীক্ষা-নীরিক্ষা সহ অসংখ্য ক্ষেত্রে পি.এইচ পরিমাপের প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাইড্রোজেন আয়ন বৃদ্ধি পেলে পানি অম্লীয়, পক্ষান্তরে হাইড্রোজেন আয়ন কমে গিয়ে হাইড্রোক্সিল আয়ন বৃদ্ধি পেলে পানি ক্ষারীয় হয়।

এসিড

টক স্বাদযুক্ত সকল পদার্থ হচ্ছে এসিড যেমন – সাইট্রিক এসিড, ল্যাকটিক এসিড, এসিটিক এসিড, হাইড্রোক্লোরিক এসিড, সালফিউরিক এসিড, কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস ইত্যাদি।

ক্ষার

যেসব পদার্থ ক্ষার ধর্মি বৈশিষ্ট্য বহন করে তারাই ক্ষার। যেমন – পাথুরে চুন (ক্যালসিয়াম অক্সাইড), কৃষি চুন (ক্যালসিয়াম কার্বোনেট), ডলোমাইট (ক্যালসিয়াম ম্যাগনেসিয়াম কার্বোনেট), স্লেটলাইম (ক্যালসিয়াম হাইড্রো আক্সাইড) অ্যামোনিয়া গ্যাস ইত্যাদি। পানির মোট ক্ষারকত্ব কম থাকলে ভোরে পানির পি.এইচ ৬-৭.৫ থাকে এবং এরূপ পানিতে ফাইটোপ্লাংক্টনের পরিমান বা ঘনত্ব বেশি থাকলে বিকালে পি.এইচ বৃদ্ধি পেয়ে ১০ বা তার বেশি হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে ক্ষারকত্ব বেশি থাকলে পানির পি.এইচ উঠানামার পরিমান বেশি হয় না। এরূপ ক্ষেত্রে ভোরে পানির পি.এইচ সাধারনত: ৭.৫-৮ এবং বিকালে ৯-১০ হয়ে থাকে। কোন কোন জলাশয় বা পুকুরে অধিক ক্ষারকত্ব এবং কম খরতা (Hardness) থাকে বিধায় সে সব জলাশয়ে ফাইটোপ্লাংক্টনের পরিমান বেশি থাকলে পানির পি.এইচ দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে বিকালে ১১ এর উপরে উঠে যায়। ক্ষারকত্ব কম থাকলে পি.এইচ দিনের বিভিন্ন সময়ে উঠানামার পরিমান বেশি কিন্তু ক্ষারকত্ব বেশি থাকলে পি.এইচ উঠানামার পরিমান কম হয়ে থাকে

মাছ চাষে pH এর প্রভাব

মাছ চাষে পানির pH এর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। আপনার পুকুরে এই pH মান ঠিক রাকতে পারলে, চাষে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে। কারণ, চাষে যত সমস্যা হয় তার মধ্যে বেশি সমস্যা হয় এর কারণে, Swingle (1967) বর্ণনা করেন অম্লীয় পানি মাছের ক্ষুধা এবং মাছের বৃদ্ধি কমিয়ে দেয়। পি.এইচ কম থাকলে মাছের ওপর হাইড্রোজেন সালফাইড, মিথেন, কপার এবং অন্যান্য ভারী ধাতুর বিষাক্ততা বৃদ্ধি পায়। পুকুরে অন্যান্য জলজ উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে অম্লীয় পানি প্রভাব বিস্তার করে। এজন্য পানিতে সবুজ ফাইটোপ্লাংক্টন না থাকলে বা সার দেওয়ার পর পানি সবুজ না হলে ধরে নিয়ে থাকি পুকুরের পানি অম্লীয় ।

এছাড়া অম্লীয় পানিতে মাছ সহজেই পরজীবি ও অন্যান্য রোগ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার প্রবনতা থাকে। সংক্ষেপে এক কথায় বলা যায় পানির পি.এইচ ৭.৫- ৮.৫ এর মধ্য অবস্থায় থাকলে তা মাছ বা অন্যান্য জলজ জীবের জৈবিক কার্যকলাপের জন্য ভালো । মাছের রক্তের পি.এইচ ৭.৪। মাছ শীতল রক্ত বিশিষ্ট প্রাণি বিধায় জলজ পরিবেশের ওপর মাছের জৈবিক ও শারীরবৃত্তীয় সকল কার্যক্রম নির্ভরশীল। এজন্য পানির পি.এইচ মাছের রক্তের পি.এইচ’র কাছাকাছি রাখতে না পারলে চাষের সময় মাছের ওপর বিরুপ প্রভাব পরে। তাই প্রতিদিন একবার করে চাষ পুকুরের পানির pH পরীক্ষা করা উচিত। পানির pH আদর্শ মাত্রা ধরে রাখতে না পারলে মাছের খাদ্য গ্রহণ বন্ধ হয়ে যায়, ফলে মাছের বৃদ্ধি কমে যায়। অক্সিজেন কমে যায়, পুকুরে গ্যাস সৃষ্টি হয়। মাছ সহজে জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়, ফলে মাছ মারা গিয়ে চাষের ব্যাপক ক্ষতি হয়।

মাছ চাষের আদর্শ pHমান কম বা বেশি প্রধানত যেসব সমস্যা হতে পারে

মাছ চাষে পানির pH এর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব অপরিসীম। আপনার পুকুরে এই pH মান ঠিক রাখতে পারলে, চাষে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে, কারণ চাষে যত সমস্যা হয় তার মধ্যে বেশি সমস্যা হয় পি.এইচ কম বা বেশি এর কারণে। তাই প্রতি দিন একবার চাষকৃত ট্যাংকের/পুকুরের পানির pH পরীক্ষা করা উচিৎ। পানির pH আদর্শ মাত্রা ধরে রাখতে না পরলে মাছের খাদ্য গ্রহণ বন্ধ হয়ে যায় ফলে মাছের বৃদ্ধি কমে যায়। অক্সিজেন কমে যায়, পুকুরে গ্যাস সৃষ্টি হয়। মাছ সহজে জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়, ফলে মাছ মারা গিয়ে চাষের ব্যাপক ক্ষতি হয়, তাছাড়াও নিন্মোক্ত সমস্যা গুলো হতে পারে-

* পি.এইচ ৬ থেকে কম এবং ৯.৫ এর অধিক মৎস্য/ চিংড়ি চাষের জন্য ক্ষতিকর, এমনকি মারাও যেতে পারে।

* পি.এইচ মাত্রাধিক বেড়ে গেলে (১১ এর অধিক) মাছ/চিংড়ির শরীরের পি.এইচ এর সাথে তা অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে মড়ক ঘটায়।

* পি.এইচ ৬ থেকে কম হলে পুকুরে প্লাংকটন (প্রাকৃতিক খাদ্য) উৎপাদন কমে বা বন্ধ হয়ে যাবে বা ফাইটোপ্লাংটন মারা যাবে এবং মাছ/ চিংড়ির ক্লেশ হয়ে মড়ক ঘটাতে পারে।

*আবার কম পিএইচে চিংড়ির খোলস নরম হয়ে যায়, খোলস পাল্টানো বন্ধ হয়ে যায়, চিংড়ি কালো হয়ে যায় এবং এদের উপাঙ্গ (বিশেষত পা ও টেলশন [লেজ] ক্ষয় হয়ে যেতে পারে।

* পি.এইচ প্রয়োজনীয় মাত্রা থেকে কম বা অধিক হলে খাদ্য গ্রহণ প্রবনতা কমে বা বন্ধ হয়ে যাবে।

বায়োফ্লক পুকুরে pH কমার কারণ

১. পুকুরের মাটি এসিটিক হলে অথবা পুকুরের তলায় হাইড্রোজেন গ্যাস জমা হলে।

২.পুকুরে এসিড জাতীয় কোন কিছুর পঁচন হলে।

৩. এসিড বৃষ্টি হলে বা পানিতে কার্বনডাইঅক্সাইড এর পরিমাণ বেড়ে গেলে বা এসিড জাতিয় কোন কিছু প্রয়াগ করা হলে ইত্যাদি।

৪, প্রোবায়োটিক সঠিক ভাবে বংশ বিস্তার করতে নাপারলে তথা ফ্লক তৈরী না হলে।

বায়োফ্লক পুকুরে pH – বেশি হলে করনীয়:

১. পানি পরিবর্তন করতে পারেন।

২. ২-৩ দিন খাদ্য বন্ধ রাখতে পারেন।

৩. প্রতি শতকে ১০০ গ্রাম করে ফিটকিরি পানিতে গুলিয়ে প্রয়োগ করতে পারেন।

৪. তেঁতুল প্রয়োগ করতে পারেন।

৫. শতকে ১০ সিসি করে মিউটারিক এসিড প্রয়োগ করতে পারেন।

৬. প্রোবায়োটিক সঠিক ভাবে বংশ বিস্তার করতে নাপারলে তথা ফ্লক তৈরী না হলে সমস্যা গুলো হয়ে থাকে, তাই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের পর সবচেয়ে ভালো হয় প্রতিশতকে ১০ গ্রাম পরিমিত মাত্রায় Floc Pro-1 বা Floc Pro-2 প্রোবায়োটিক প্রয়োক করা কারণ প্রোবায়োটিক রাতে ও দিনে pH মান ৭.৫ – ৮.৫ এর মধ্যে ধরে রাখতে সহায়তা করে।

বায়োফ্লক পুকুরে pH কেন বৃদ্ধি পায়

১. অতিরিক্ত খাদ্যের পঁচনের ফলে।

২. প্ল্যাঙ্কটন ব্লুম হয়ে তা পঁচে গিয়ে।

৩. মাছের মল বা জৈব অংশের পঁচন।

৪. ক্ষার জাতীয় পদার্থের মাত্রাধিক ব্যাবহার।

৫. অ্যামোনিয়া, নাইট্রেট, নাইট্রাইট গ্যাসজনিত কারণ।

৬, প্রোবায়োটিক সঠিক ভাবে বংশ বিস্তার করতে নাপারলে তথা ফ্লক তৈরী না হলে।

বায়োফ্লক পুকুরে pH কম হলে করনীয়

১. পানি পরিবর্ত করতে হবে।

২. চুন প্রয়োগ করতে হবে।

৩. চুন প্রয়োগের ২ দিন পর প্রোবায়োটিক সঠিক ভাবে বংশ বিস্তার করতে নাপারলে তথা ফ্লক তৈরী না হলে সমস্যাগুলো হয়ে থাকে, তাই পরিমিত মাত্রায় Floc Pro-1 বা Floc Pro-2 প্রোবায়োটিক প্রয়োগ করতে হবে।

পানির pH সহজে পরীক্ষা করে কম সময়ে সঠিক মান জানার জন্য রয়েছে বিভিন্ন টেস্ট কীট, এর মধ্যে ভালো কোয়ালিটির টেস্ট কীট সংগ্রহ করুন।

লেখক: ম্যানেজিং পার্টনার, সরকার এগ্রো ফিসারিজ ও বারানি বায়োটেক ফিস কালচার।

This post has already been read 8877 times!