Friday 29th of March 2024
Home / এক্সক্লুসিভ / নিরাপদ খাদ্য ফাউন্ডেশন গঠন করা হোক

নিরাপদ খাদ্য ফাউন্ডেশন গঠন করা হোক

Published at জুলাই ২৬, ২০১৮

আতাউর রহমান মিটন : বাংলাদেশের কৃষকের আর্থ-সামাজিক অবস্থা যেমনই হোক না কেন, কৃষির সামগ্রিক উন্নতিতে উল্লসিত সরকার। কৃষিকাজের সাথে জড়িত বিপুল জনগোষ্ঠীর নিরলস প্রয়াসের কারণেই জাতীয় আয়ে এখনও কৃষির অবদান প্রায় ১৫%। সরকারী মতে, দেশের মোট জনসংখ্যার ৪৫% ভাগ লোক কৃষি কাজের সাথে জড়িত। কৃষিনির্ভর অন্যান্য পেশাসমূহকে বিবেচনায় নিলে এই জনগোষ্ঠীর পরিমাণ আরও বেশি। কৃষিই আমাদের অর্থনীতি এবং জীবীকায়নের প্রাণ! ‘কৃষি বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে’ – কথাটা মোটেও অত্যুক্তি নয়। আর সে কারণেই কৃষিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে আমাদের কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে গতির সঞ্চার এখন সময়ের দাবী। এই খাতের সংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে করেন, বিনিয়োগ বাড়লেই বহুমুখী কৃষি সম্প্রসারণ সেবার পরিধি বাড়ানো সম্ভব হবে।

ধান, আলু, ডাল, ভূট্টা ও মশলার গন্ডি পেরিয়ে কৃষিতে ফল-ফলাদি ও সারাবছরব্যাপী সব্জি চাষের বিপ্লব ঘটেছে। এর ফলে একদিকে যেমন খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে অপরদিকে তেমনি কৃষি প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে আগের চেয়ে বেশি অবদান রাখা সম্ভব হচ্ছে। আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতি এখনও কৃষির উপর নির্ভর করে দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। সরকারের যুগান্তকারী একাধিক উদ্যোগের ফলে কৃষিজাত ও অন্যান্য খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন নজর দিতে হবে নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের দিকে।

সম্প্রতি মন্ত্রীসভায় ‘জাতীয় কৃষি নীতি-২০১৮’ অনুমোদিত হয়েছে। সর্বপ্রথম ১৯৯৯ সালে জাতীয় কৃষি নীতি প্রণীত হয়েছিল। এর পরে ২০১৩ সালে এই সরকারের আমলেই দ্বিতীয় নীতিটি প্রণীত হয়েছিল। সর্বশেষ ২০১৮ সালে সংশোধিত এই নতুন কৃষি নীতিতে সরকারের কৃষি, খাদ্য ও পরিবেশ সংশ্লিষ্ট আরও কয়েকটি নীতির প্রক্ষেপণ রয়েছে। এর ফলে সদ্য অনুমোদিত এই ‘জাতীয় কৃষি নীতি’ পূর্বের ধারাবাহিকতায় একটি যুগোপযোগী নীতি হিসেবে সরকারের কৃষি উন্নয়ন কর্মসূচীকে আরও গতিশীল করবে বলে সংশ্লিষ্টদের বিশ্বাস। তবে এর জন্য কর্মসূচী পরিকল্পনা বা এ্যাকশন প্লান সুস্পষ্ট ও সূচারু হওয়া দরকার।

খাদ্য মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার। আর মানুষের খাবারের উৎস বহুবিধ হলেও ফসল একটি অন্যতম প্রধান উৎস। তাই ফসলখাতের উন্নয়নে সরকারের সর্বাধিক গুরুত্বদান নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। তথাপি আমাদের জনসংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তাতে আগামী দিনগুলোতে মানুষের চাহিদানুযায়ী নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিতে পারে। চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে উৎপাদন বাড়াতে না পারলে টাকা দিয়ে খাবার কিনে এনে বাংলাদেশের সকল মানুষের খাদ্য অধিকার নিশ্চিত করা কঠিন হবে। টাকা থাকলেই যে সময়মত খাদ্য কেনা যায় না বা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় না তা ২০০৭ সালে বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছে। সুতরাং আমাদের উৎপাদন বদ্ধির দিকে নজর দিতে হবে। ফসলজাত খাদ্যের পাশাপাশি প্রাণীজ খাদ্য উৎসসমূহেরও উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সহায়তা বৃদ্ধি করতে হবে।

খাদ্য উৎপাদন আরও বাড়াতে হবে এটা সত্য কিন্তু ফলন বৃদ্ধি করতে যেয়ে উৎপাদিত খাদ্যের পুষ্টিমান এবং নিরাপদতা নিয়ে কোন আপোষ করা চলবে না। আমাদের গবেষকদের সামনে এখন উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে খাদ্যের নিরাপদতা ও পুষ্টিমান নিশ্চিত করাটা একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। খাদ্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে রাসায়নিক সার, কীটনাশক, গ্রোথ হরমোন, এন্টিবায়োটিক ও অন্যান্য নানা ধরণের কেমিক্যাল ইত্যাদির যথেচ্ছা ব্যবহার আমাদের খাদ্যচক্রকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। গণমাধ্যমে নানা ধরণের প্রতিবেদন প্রকাশ পাওয়ায় খদ্যের নিরাপদতা নিয়ে জনমনে সচেতনতা ও সংশয় সৃষ্টি হয়েছে যা অবসান হওয়া প্রয়োজন।

জাতীয় কৃষি নীতি -২০১৮ এর প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে “ফসলের উৎপাদনশীলতা ও কৃষকের আয় বৃদ্ধি, শস্য বহুমুখীকরণ, পুষ্টি সমৃদ্ধ নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, দক্ষ প্রাকৃতিক স¤পদ ব্যবস্থাপনা, টেকসই প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন।” কোন সমালোচকের পক্ষেই এই উদ্দেশ্যের সাথে দ্বিমত করা সম্ভব নয়। তা সত্বেও আমরা দ্বিধান্বিত কারণ একটি কার্যকর এ্যাকশন প্লান ছাড়া এই কৃষি নীতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। এটা অনেকটাই ‘ফাইলবন্দী একটি সুলিখিত ডকুমেন্ট’ হিসেবে রয়ে যাবে। আমরা সেটা হতে দিতে বা দেখতে চাই না।

এবারের কৃষি নীতিতে প্রায় সকল মহলের স্বার্থ বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে আধুনিক কৃষির বিস্তারের বিষয়টি এই নীতিতে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এই নীতিতে বিশেষায়িত কৃষির পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্য ও কৃষি পণ্য উৎপাদন, বিপণন, রপ্তানী, কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও শিল্প সম্প্রসারণ, আন্তর্জাতিক বাজার উন্নয়নসহ নারীর ক্ষমতায়ন, কৃষিতে যুবসমাজকে সম্পৃক্ত করা, কৃষি সমবায় গঠন এর মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো স্থান পেয়েছে।

সরকার এই নীতিতে যে উপলদ্ধি ব্যক্ত করেছেন তার আলোকে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলে আমাদের কৃষিখাত আগামীতে আরও অনেক বেশি সমৃদ্ধ হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। সমস্যা হলো সরকার আদৌ সেটা করবেন কি না। যেমন কৃষি নীতিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে কৃষি সমবায় গঠনের কথা। কিন্তু আমার জানা মতে, সরকারের কৃষি বিভাগ থেকে কৃষি সমবায় বা কৃষি ক্লাবগুলোকে রেজিষ্ট্রেশন প্রদানের কোন বিধান নেই। যদি নারীর ক্ষমতায়ন কার্যক্রমকে এগিয়ে নেবার জন্য মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর নারী সংগঠনগুলোকে রেজিষ্ট্রেশন প্রদান ও অন্যান্য সহায়তা দিতে পারে, যদি যুবদের ক্ষমতায়নের জন্য যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর যুব সংগঠনগুলোকে রেজিষ্ট্রেশন প্রদান ও অন্যান্য সহায়তা দিতে পারে, তাহলে কৃষি ও কৃষকের ক্ষমতায়নে কেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বা সহায়ক অপর কোন সংস্থা দেশের কৃষি ক্লাব বা কৃষি সংগঠন বা কৃষি সমবায়কে রেজিষ্ট্রেশন প্রদান করতে পারবে না? সরকারের সমবায় অধিদপ্তর থেকে বর্তমানে কৃষি সমবায় এর রেজিষ্ট্রেশন দেয়ার বিধান থাকলেও সেটা জাতীয় কৃষি নীতির আলোকে কৃষি ও কৃষকের ক্ষমতায়নে সহায়তা করতে পারবে না। যার যার কাজ তাদেরই করতে দিতে হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর হলো কৃষি সম্পর্কিত অভিভাবক সংগঠন তাই এটা তাদের তত্বাবধানেই হওয়া উচিত। বলা বাহুল্য, এই রেজিষ্ট্রেশন বিধান না থাকার কারণে সরকারের আইপিএম/আইসিএম ক্লাবগুলো এখন এতিমদের মত এখানে ওখানে গড়াগড়ি খেয়ে মরে যেতে বসেছে। সরকার আগেও কৃষি সংগঠন, কৃষি সমবায়কে প্রণোদিত করতে চেয়েছেন কিন্তু এ লক্ষ্যে কাজ হয়েছে কতটুকু?

এবারের নীতিমালায় নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন এবং বিপণনকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে নিরাপদ খাদ্য চক্র এক জটিল ব্যবস্থাপনা। খাদ্যের মৌল উপাদান কৃষি হলেও ভোক্তার পাতে যে খাদ্য পরিবেশিত হয় সে অবস্থায় উন্নীত হতে নানা ধাপ অতিক্রম করতে হয়। খাদ্য ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত প্রায় ২৫ লক্ষ ব্যক্তি ও ১৮টি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করাটা এখনও অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জ। ‘খাদ্যমান মনিটরিং’ ব্যবস্থাপনা জোরদার করা দরকার কিন্তু কাজটা সহজ নয়। বিদেশ থেকে আমদানীকৃত খাদ্যপণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত হয়ে ছাড়পত্র দেয়ার কাজটাও সহজ নয়। নিরাপদ খাদ্য চক্র নিশ্চিত করতে হলে আমাদের সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন আর সেজন্য প্রয়োজন বিনিয়োগ বৃদ্ধি। অনেক উদ্যোক্তা আছেন যাঁরা যথাযথ সহায়তা না পেয়ে নিরাপদ খাদ্য বিপণনে এগিয়ে এসেও পিছপা হয়েছেন অথবা ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবছেন। কেউ কেউ হয়তো বলবেন ‘কৃষি ঋণ সহজলভ্য’। আমি সবিনয়ে এই মন্তব্যে দ্বিমত প্রকাশ করছি। বিদ্যমান সুদের হার কৃষি বিকাশে সহায়ক নয়। কাগজে-কলমে যাই লেখা থাকুক না কেন, বাস্তবে বিষয়টা অন্যরকম। বিদ্যমান এই জটিলতা অবসানে বিসেফ ফাউন্ডেশন নামে একটি বেসরকারী নেটওয়ার্ক এর পক্ষ থেকে সরকারের জাতীয় কৃষি নীতি-২০১৮ এবং নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ এবং ভোক্তা অধিকার আইন এর উদ্দেশ্যসমূহ অর্জনে অবিলম্বে ‘নিরাপদ খাদ্য ফাউন্ডেশন’ গঠনের প্রস্তাব করেছে। এসএমই ফাউন্ডেশন, পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন, হর্টেক্স ফাউন্ডেশন বা কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন এর আলোকে ‘নিরাপদ খাদ্য ফাউন্ডেশন’ গঠিত হলে সেই ফাউন্ডেশন নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনায় উদ্যোক্তা তৈরী ও অর্থায়নে সহায়তা করতে পারে। প্রস্তাবিত ‘নিরাপদ খাদ্য ফাউন্ডেশন’টি সরকারের কৃষি বা খাদ্য যে কোন মন্ত্রণালয়ের অধীনেই স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে যেতে পারে।

প্রস্তাবিত নিরাপদ খাদ্য ফাউন্ডেশনের লক্ষ্যসমূহ:
(১) সারাদেশে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বিপণনে নিয়োজিত ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সংস্থাগুলোর তালিকাভূক্ত করা
(২) নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনায় গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনায় সহায়তা করা
(৩) নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনায় জড়িত ব্যক্তিবর্গের দক্ষতা বৃদ্ধিতে পদক্ষেপ গ্রহণ ও সহায়তা করা
(৪) নিরাপদ খাদ্য ভ্যালু চেইন নিশ্চিতকরণে স্বল্প বা রেয়াতি হারে অর্থায়ন করা বা অর্থায়নে সহায়তা করা
(৫) নিরাপদ খাদ্য আইনের যথাযথ বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে গৃহীত সহায়ক কার্যক্রমে সম্ভাব্য সহযোগিতা প্রদান করা
(৬) সর্বস্তরে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য আইনের যথাযথ বাস্তবায়নে সামাজিক প্রণোদনা সৃষ্টি তথা গণ জাগরণমূলক কর্মসূচী পরিচালনা করা।

নিরাপদ খাদ্য ফাউন্ডেশন গঠনের এই প্রস্তাব জাতীয় কৃষি নীতি – ২০১৮ এর উদ্দেশ্য অর্জনে সহায়ক। কারণ এই নীতিতে কৃষিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রস্তাব রয়েছে। বিসেফ ফাউন্ডেশন যে প্রস্তাব করেছে তা মূলতঃ বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা কৌশল সম্পর্কিত। অর্থাৎ যে বিনিয়োগ বৃদ্ধির কথা বলছে তা বিচ্ছিন্নভাবে না করে বরং একটি ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে করার প্রস্তাব করা হচ্ছে মাত্র। জাতীয় কৃষি নীতিতে প্রস্তাবিত ‘উত্তম কৃষি অনুশীলন’ এর আলোকেও এ বিষয়ে আরও আলোচনা হতে পারে।

মূল কথাটা হচ্ছে, গন্ডির বাইরে বেরিয়ে চিন্তা করা। ফুটো পাত্র দিয়ে পানি সেচলে যেমন ফল হয় না, ঠিক তেমনি পুরনো গতানুতিক কায়দা-কানুন বহাল রেখে নিরাপদ খাদ্য ভ্যালু চেইন গড়ে তোলা কঠিন। সরকারের শুভ উদ্যোগের সাফল্য কামনা করি। প্রত্যাশা করি সরকার খোলামন নিয়ে নাগরিক সমাজের ভাবনাগুলো বিবেচনা করবেন। জনতার আকাঙ্খা পূরণে যারা এগিয়ে আসবেন তাঁরাই থাকবেন জনতার হৃদয়ে।

This post has already been read 4530 times!