Thursday 18th of April 2024
Home / বিজ্ঞান ও গবেষণা / ধান বীজ সংরক্ষণের কার্যকর প্রযুক্তি: বায়ুরোধী ব্যাগ

ধান বীজ সংরক্ষণের কার্যকর প্রযুক্তি: বায়ুরোধী ব্যাগ

Published at আগস্ট ২৫, ২০২০

গবেষণায় দেখা গেছে, হার্মেটিক (বায়ুরোধী) ব্যাগ (চিত্র ১) ধান ও বীজ সংরক্ষণে খুবই কার্যকর।

ড. মোহাম্মদ আফজাল হোসাইন : কথায় আছে, ভাল বীজে ভাল ফসল। গবেষণায়ও তাই প্রমাণিত হয়েছে, মান সম্পন্ন বীজ ব্যবহার করে ধানের ফলন ১০-১৫% বেশী পাওয়া যায়। খাদ্য নিরাপত্তার প্রধান হাতিয়ার হলো ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি। এর দুটো উপায়: ১) আবাদী জমির পরিমান বাড়ানো ২) উচ্চফলনশীল (উফশী) নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন। শিল্প ও নগরায়নের ফলে প্রতি বছর আবাদী জমির পরিমান ০.৫১ ভাগ হারে কমে যাচ্ছে। তাই আবাদী জমির পরিমান বাড়ানোর তেমন সুযোগ নেই। এখন প্রয়োজন উচ্চফলনশীল (উফশী) জাত উদ্ভাবন। এজন্যে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ১০২টি উফশী জাত উদ্ভাবন করেছেন। প্রতি বছর জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু হ্রাস পাচ্ছে আবাদী জমি তা সত্ত্বেও উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ, সঠিক মাত্রায় ও সময়ে সার প্রয়োগ, পরিমিত সেচ, কীটনাশক, আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহারের ফলে দেশের ধান উৎপাদন বিগত ৪৮ বছরে তিনগুনেরও বেশী সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশের মোট বীজ চাহিদার মাত্র ৫১, ৯% উন্নত মানের বীজ সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে সরবরাহ করে থাকে। বাকী ৪০% বীজ, কৃষক নিজ ব্যবস্থাপনায় চাহিদা পূরণ করে থাকেন। সাধারণত কৃষকের রক্ষিত বীজ ধানই বীজ এর প্রধান উৎস, বেশির ভাগ কৃষকই তাদের রক্ষিত বীজ বদল করে না এবং করার ব্যবস্থা নাই বিধায় অনেক ক্ষেত্রে বীজের গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়। সঠিক পদ্ধতিতে, সঠিক পাত্রে ধান সংরক্ষণ করে কৃষকগণ অধিক ফলন পেয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারেন এবং আমরা খাদ্য নিরাপত্তা লাভ করতে পারি।

বায়ুরোধী ব্যাগ ব্যবহারে সুবিধাসমূহ

  • সহজেই ব্যবহার করা যায় এবং পূন:ব্যবহার উপযোগী।
  • ধান, গম, ভূট্টা, সয়াবিন, কফি প্রভৃতির সংরক্ষণকালীন অপচয় হয় না বললেই চলে।
  • শস্যের রং ও গুনগত মান ঠিক থাকে।
  • বীজের মান অক্ষুন্ন ও অটুট থাকে (বীজের অংকুরোদগম ৯০% এর বেশী থাকে)।
  • কোন প্রকার রাসায়নিক ব্যবহার ব্যতীত বীজ ভাল থাকে, কোন প্রকার রাসায়নিক ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না, তাই এটি ব্যবহার নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব।
  • কৃষককে বীজ ক্রয়ের কষ্টার্জিত অর্থ ব্যয় করতে হয় না। উপরোক্ত চাহিদার অতিরিক্ত বীজ বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যায়, এবং
  • কৃষকের নিজ গৃহে বীজ ধান রাখা সম্ভব(চিত্র ২), অতিরিক্ত জায়গার জন্যে আর্থিক বিনিয়োগ করতে হয় না।

    বায়ুরোধী ব্যাগে সংরক্ষিত ধানের নমুনা সংগ্রহ ও পর্যবেক্ষণ

বীজ ধান সংরক্ষণে করনীয়

ক) ধান সংগ্রহ

ধানের ছড়ার উপরের দিকে শতকরা ৮০ ভাগ ধানের চাল শক্ত ও ধান পেকেছে বলে মনে হলেই বিলম্ব না করে ধান কেটে মাড়াই করা উচিত। চাটাই, চট বা পলিথিন বিছিয়ে এসবের উপর মাড়াই করলে ধানের রঙ উজ্জ¦ল ও পরিস্কার থাকে।

খ) ধান শুকানো পদ্ধতি

  • ধান রোদে শুকালে প্রতি ঘন্টায় কমপক্ষে দুই থেকে তিন বার ধান উল্টিয়ে দিতে হবে। শুকনো ধান দাঁতে কামড় দিলে যদি কট কট শব্দ হয় তাহলে বুঝতে হবে ধান ভালভাবে শুকিয়েছে। এক্ষেত্রে আর্দ্রতামাপক যন্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে।
  • ধান ভালভাবে শুকিয়ে (আর্দ্রতা ১২% অথবা এর নিচে থাকে) পরিস্কার করে ও ঠান্ডা করে পাত্রে ভরতে হবে।

গ) বায়ুরোধী ব্যাগ ব্যবহার কৌশল

  • শুকনো এবং ঠান্ডা শস্য/বীজ দিয়ে ব্যাগটি এমনভাবে ভর্তি করি যেন মূখটি বন্ধ করতে কোন প্রকার অসুবিধা না হয়।

    প্লাস্টিক ব্যাগে সংরক্ষিত গ্রেইনপ্রো ব্যাগ

  • ব্যাগের খালি অংশ মুড়িয়ে বায়ুশুন্য করে ক্লিপ দিয়ে আটকিয়ে নিতে হবে
  • শস্যভর্তি গ্রেইনপ্রো ব্যাগটি কখনোই পরিবহন করা যাবে না, ব্যাগটি স্থানান্তর বা পরিবহনের জন্যে অন্য একটি পাটের/প্লাষ্টিকের বস্তায় ভরে নিতে হবে (চিত্র ৩)

আর্থিক সুবিধা : গবেষণায় দেখা গেছে, প্রচলিত পদ্ধতিতে ধান সংরক্ষন করলে প্রায় ৬-৭% (৬০-৭০ কেজি/টন) অপচয় হয়। অথচ বায়ুরোধী ব্যাগে ধান সংরক্ষণ করলে এ অপচয় হয় না অর্থাৎ ১,২০০-১,৪০০ টাকা স্বাশ্রয় হয়। বায়ুরোধী ব্যাগে প্রতি মন বীজ ধান সংরক্ষণ করে ৬০০ টাকা আয় করা সম্ভব হয়।

পুষ্টি সুবিধা : প্রচলিত পদ্ধতিতে ধান সংরক্ষন করলে পোকা আক্রমন করে ধানের ভিতরকার এন্ডোসর্পাম খেয়ে ফেলে। এতে পুষ্টি মান নষ্ট হয়। বায়ুরোধী ব্যাগে সংরক্ষণ করলে পোকার আক্রমণ হয় না বলে ধানের পুষ্টিমান অক্ষুন্ন থাকে।

জেন্ডার সুবিধাদি : প্রচলিত পদ্ধতিতে ধান সংরক্ষনকালে ২-৩ বার ধান বের করে শুকাতে হয়। একজন গৃহিণী বায়ুরোধী ব্যাগে একা ধান সংরক্ষণ করতে পারেন। বাড়তি কোন শ্রমিকের প্রয়োজন হয় না। ফলে বায়ুরোধী ব্যাগে ধান সংরক্ষনকালে ৫০০-৬০০ টাকা স্বাশ্রয় হয় যা দিয়ে তিনি বাচ্চার পড়াশূনা, চিকিৎসা বা ব্যক্তিগত প্রযোজনে ব্যয় করতে পারেন।

লেখক: সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট

This post has already been read 3987 times!