Friday 19th of April 2024
Home / অর্থ-শিল্প-বাণিজ্য / চামড়ার দরপতনের নেপথ্য কাহিনী

চামড়ার দরপতনের নেপথ্য কাহিনী

Published at আগস্ট ১৬, ২০১৯

রাশিম মোল্লা: পুরান ঢাকার পোস্তার মো. দিপু। তিনি দিপু এন্টারপ্রাইজের মালিক। ১২ বছর বয়স থেকে পশুর চামড়ার ব্যবসার সঙ্গে পরিচিত। চামড়া শিল্পের এমন করুণ অবস্থা আগে তিনি কখনো দেখেননি। তাই রাগ, ক্ষোভ আর বিষন্নমনে প্রতিষ্ঠানের সামনে বসে ছিলেন গতকাল। বলেন, চামড়া ব্যবসাটা এতটাই ভালোবাসি যে অনেকবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই ব্যাবসা আর করব না। কিন্তু যখন ঈদ আসে তখন আর নিজেকে বিরত রাখতে পারি না। গতবছরের ঈদেও তিনি ২৫ হাজার চামড়া সংগ্রহ করেছিলেন।

আর এ বছর ১৬ হাজারের মতো চামড়া সংগ্রহ করেছেন। ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, গতবছর প্রগতি লেদারের মালিক হাজী নূরে আলমকে কাঁচা চামড়া সরবরাহ করেছি।

তার কাছে আমি এখনো ৩৬ লাখ টাকা পাব। ঈদের আগেই ট্যানারি মালিককে জানিয়েছিলাম, বকেয়া পরিশোধ করার জন্য। কিন্তু তিনি আমাকে বকেয়ার মাত্র ৫ লাখ টাকা পরিশোধ করেন। অপরদিকে, আল মদিনা লেদারের মালিক জানে আলমের কাছে ৩০ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে। অনেক অনুনয় বিনয় করার পর তিনি আমাকে মাত্র ১ লাখ টাকা দেন। ফলে এবার ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও পর্যাপ্ত চামড়া ক্রয় করতে পারিনি। তিনি আরো বলেন, প্রতিবছর ঈদের আগেই মৌসুমী ব্যাবসায়ীদের পর্যাপ্ত পরিমানে চামড়া সংগ্রহ করার তাগিদ দেয়া হয় । কত টাকা দরে ক্রয় করলে তার লাভ হবে। এসব বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ দিক নির্দেশা দেয়া হয়। এবারও তাদেরকে দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তবে এবার তাদেরকে কম চামড়া সংগ্রহের টার্গেট দেয়া হয়েছে। যে কারণে এ বছর তেমন একটা মৌসুমি চামড়া ব্যাবসায়ীর দেখা মিলেনি। চামড়া ব্যাবসায়ী দিপু জোর দিয়ে বলেন, ট্যানারি মালিকরা যদি আমাদের বকেয়া পরিশোধ করতো ও চামড়া সংগ্রহের নিশ্চয়তা দিতো তাহলে আর পথে ঘাটে, নদীতে চামড়া পাওয়া যেত না।

বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হাজী মো. টিপু সুলতান বলেন, এ বছর চামড়াখাতের খুব খারাপ অবস্থা। ট্যানারি মালিকদের কাছে গত ত্রিশ বছরে আমাদের ৩০০ কোটি টাকা বকেয়া পড়েছে। এর মধ্যে গত বছরের বকেয়া প্রায় ৩০ কোটি টাকা। তিনি বলেন, ঈদের আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমাদের মিটিং হয়। ওই মিটিং-এ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে আমরা মৌখিকভাবে ২০০ কোটি টাকা এডভান্স পেমেন্ট করতে বলেছিলাম। কিন্তু মন্ত্রণালয় আমাদের দেননি। মন্ত্রণালয় জানায়, আপনাদের বকেয়া পরিশোধের জন্য ট্যানারি এসোসিয়েশনকে ৬০০ কোটি টাকার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। অথচ ট্যানারি মালিকরা হাতে গোনা কিছু আড়তদার ছাড়া কারো বকেয়াই পরিশোধ করেনি।

চামড়া ব্যাবসায়ী মো. সমির উদ্দিন বলেন, মূলধন সংকটের জন্য নয়, অন্য কারণে এবার পর্যাপ্ত চামড়া থাকা স্বত্বেও কিছু চামড়া তিনি সংগ্রহ করেছেন। ট্যানারি মালিকরা এবার আগের মতো চামড়া সংগ্রহ করার জন্য আমাদের তাগিদ দেয়নি। এমনকি চামড়া সংগ্রহের ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তাও দেননি মালিকরা। পর্যাপ্ত চামড়া সংগ্রহ না করার অন্যতম কারণ এটি। তিনি বলেন, প্রায় ৪৪ বছর ধরে চামড়ার ব্যাবসা করছি। এ বছরের মতো চামড়ার দরপতন আগে কখনো হতে দেখেননি। গত বছর তিনি ৬ হাজার চামড়া সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু এ বছর তিনি সর্বসাকুল্যে আড়াই হাজার চামড়া সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু চামড়ার এই দশা কেন হলো?- ট্যানারি মালিকরা দুষছেন আড়তদারদের, আড়তদাররা বলছেন ট্যানারি মালিকদের দায়।

মৌসুমী ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সিন্ডিকেট করে কাঁচা চামড়ার দাম কমানো হচ্ছে। অন্যদিকে আড়তদাররা বলছেন, চামড়া কেনার পুঁজিই নেই তাদের। মৌসুমি ব্যবসায়ীরাই এবার দাম কম বলেছিলেন। সেটা আবার গতবারের লোকসানের কারণে। দুইশ, আড়াইশ, তিনশ টাকাতেও গরুর চামড়া কিনেছেন তারা। কিন্তু তাতেও যে লাভ হয়েছে এমন নয়। আড়তে আসার পর একশ, দেড়শ টাকা দাম শুনে মেজাজ হারিয়ে এখানে সেখানে ফেলে দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন তারা। কোথাও কোথাও গর্ত করে মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে। ফেলা হয়েছে নদীতে।

পাইকারি চামড়া ব্যবসায়ীদের থেকে পাওয়া তথ্য মতে, ট্যানারি মালিকরা ঈদের আগেই তাদের হাতে মূলধন তুলে দেয়ার কথা। যা দিয়ে তারা খুচরা ব্যবসায়ীদের থেকে এবং নিজেরা সরাসরি চামড়া কিনবেন। এ সময় চামড়া কিনতে নিজেরাও মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ করেন। আর ট্যানারিতে চামড়া পৌঁছার পরেও বাকি থাকে টাকা। এক বছরের টাকা পরের বছরেও দেয়া হয়। কিন্তু ২০১৭ সালে এসে অগ্রিম টাকা দেয়া বন্ধ করে দেন ট্যানারি মালিকরা। সেই সাথে পাইকারদের অনেক টাকা বাকি পড়ে ট্যানারি মালিকদের কাছে। বকেয়া টাকা এক বছরেরটা পরের বছরও পাচ্ছেন না এসব পাইকারি ব্যবসায়ী। এখন পর্যন্ত প্রচুর টাকা বকেয়া আছে ট্যানারির কাছে। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে নিজেদের পকেট থেকে টাকা দিয়ে চামড়া কিনছিলেন এসব পাইকার। কিন্তু গত বছর পাইকারদের থেকে বাকিতে চামড়া নেয়ার পাশাপাশি ট্যানারি মালিকরা খুচরা ব্যবসায়ীদের সরাসরি চামড়া কিনেছেন এমন অভিযোগ পাওয়া গিয়েছিল।

এই অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক শাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, সরকার প্রকৃতপক্ষে আমাদেরকে সর্বসাকুল্যে ১৫০ কোটি টাকা দিয়েছে। সরকার যে বলছে ৬০০ কোটি টাকা দিয়েছে এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, গত দুই বছর সরকার আমাদেরকে যে লোন দিয়েছে, সেই লোন পরিশোধ করতে পারিনি। সেটা এডজাস্ট করে সরকার বলছে আমাদেরকে ৬০০ কোটি টাকা দিয়েছে। ১৫০ কোটি টাকা থেকে আপনারা আড়তদার ও ব্যাবসায়ীদের কতটাকা বকেয়া পরিশোধ করেছেন এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মালিকার অনেকে জানিয়েছেন, কেউ অর্ধেক বকেয়া, কেউ আবার পুরো বকেয়া পরিশোধ করেছে। তিনি আরো বলেন, গত কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম কম। চাহিদাও কিছু কমেছে। যে কারণে এবার চামড়ার দাম অনেকটা কম।

This post has already been read 2411 times!