Friday 29th of March 2024
Home / সাক্ষাৎকার / চরম সংকটে আছি ফিডমিলে কাঁচামাল সরবরাহকারীরা -আরিফুল হক মনির

চরম সংকটে আছি ফিডমিলে কাঁচামাল সরবরাহকারীরা -আরিফুল হক মনির

Published at এপ্রিল ১, ২০১৮

জনাব আরিফুল হক মনির। দেশের পোলট্রি, মৎস্য ও ক্যাটল ফিড তৈরির জন্য যেসব কাঁচামাল প্রয়োজন হয় সেগুলোর আমদানি ও সরবরাহকারক। বেঙ্গল প্রোটিন অ্যান্ড ফ্যাট সাপ্লায়ার কোম্পানির অপারেশন ডিরেক্টর। বয়সে তরুন এ ব্যবসায়ী তাঁর প্রতিষ্ঠান, ব্যবসার বর্তমান অবস্থা, সমস্যা ইত্যাদি খুঁটিনাটি বিষয়ে কথা বলেছেন এগ্রিনিউজ২৪.কম এর সাথে। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন এগ্রিনিউজ২৪.কম -এর সম্পাদক ও সিইও মো. খোরশেদ আলম জুয়েল

এগ্রিনিউজ২৪.কম: বেঙ্গল প্রোটিন অ্যান্ড ফ্যাট সাপ্লায়ার কোম্পানি সম্পর্কে কিছু বলুন ?

আরিফুল হক মনির: বেঙ্গল প্রোটিন প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৭ সালে। ‘কোয়ালিটি ও কমিটমেন্ট’ -এ দুটো মূল মন্ত্রকে সামনে রেখে দীর্ঘ ২১ বছর ধরে আমরা অত্যন্ত সুনামের সহিত ব্যবসা পরিচালনা করে আসছি। মিট এন্ড বোন মিল, ফিসমিল, ফিসঅয়েল, পিকেই, ডিডিজিএস, সিজিএম, কর্ণ প্রোটিন কনসেন্ট্রেট, সয়াবিন, পোল্ট্রি মিল, ভুট্টা, র‌্যাপসিট ইত্যাদি কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করে থাকি এবং বাংলাদেশের ছোট-বড় ফিডমিলগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী আমরা কাঁচামাল সরবরাহ করে থাকি।

এগ্রিনিউজ২৪.কম: বাংলাদেশে আপনাদের রয়েল কাস্টমার কারা?

আরিফুল হক মনির: দেশের ছোট-বড় প্রায় সব ফিডমিলগুলোর সাথেই আমাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ব্যবসা আছে। মোটামুটি সব কাস্টমারকে আমরা সমান গুরুত্ব দিয়ে থাকি। তবে রয়েল বলতে যা বোঝায় সেগুলোর নাম বলতে গেলে -কাজী, নারিশ, আফতাব, নাহার, সিপি, আরআরপি, এজি এগ্রো, স্পেক্ট্রা হেক্সা, নিউ হোপ চায়না এবং ইনডেক্স উল্লেখযোগ্য।

এগ্রিনিউজ২৪.কম: আপনাদের সব কাঁচামাল কি বিদেশ থেকে আমদানি করেন?

আরিফুল হক মনির: জ্বি, বাংলাদেশের কোন কাঁচামাল আমাদের এখানে নেই। আমরা পোল্ট্রি, ফিস ফিড এবং ক্যাটল ফিড -এর কাঁচামাল সম্পূর্ণই বিদেশ থেকে আমদানি করে থাকি। ইউএসএ, আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিল এই তিনটা দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি কাঁচামাল আমদানি করে থাকি। আমাদের লাইনস্টোনগুলো মূলত আসে মিশর থেকে, ভারত থেকে আসে র‌্যাপসিট এবং পাল্ম কার্ণেল আসে মালয়েশিয়া থেকে যা ক্যাটল ফিড তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

এগ্রিনিউজ২৪.কম: বর্তমানে আপনাদের ব্যবসার পরিস্থিতি কেমন চলছে?

আরিফুল হক মনির: সত্যি কথা বলতে, বর্তমানে আমাদের ব্যবসা খুব সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

এগ্রিনিউজ২৪.কম: ব্যবসা সংকটের মূল কারণ কী?

আরিফুল হক মনির: মূলত পরিবহণ সংকট আমাদের ব্যবসা সংকটের অন্যতম একটি কারণ এবং এই পরিবহন সংকটের মূল কারণ এক দেশে তিন নীতি। নতুন কিছু নীতি পলিসির কারণে বর্তমানে এমন পরিস্থিতি বিরাজ করছে। যেমন- চট্টগ্রাম থেকে কাঁচামাল নিয়ে ট্রাকগুলো দেশের অন্যান্য জেলাগুলোতে সরবরাহের সময় আসার পথে মিরেরসরাই এবং দাউদকান্দি এই দুই জায়গায় ওজন স্কেল বসানো হয়েছে। আগে আমরা প্রতি ট্রাকে যেখানে ২০-২২ টন পণ্য সরবরাহ করতে পারতাম এখন সেটির পরিমাণ প্রায় অর্ধেক। কারণ নতুন পলিসি অনুযায়ী কাঁচামালসহ ট্রাকের ওজন হতে হবে সর্বোচ্চ ২২মে.টন। ট্রাকের ওজন বাদ দিলে বর্তমানে ট্রাকপ্রতি কাঁচামাল সরবরাহ করা যাচ্ছে ১২-১৩ মে.টন। কিন্তু ট্রাকের ভাড়া কমেনি। ফলে পূর্বের ভাড়ায় বর্তমানে প্রায় অর্ধেক পরিমান পণ্য সরবরাহ করতে পারছি। এতে করে পরিবহন খরচ প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, চাহিদা মোতাবেক পরিবহন পাওয়া যাচ্ছেনা। চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতিদিন যতগুলো ট্রাকের প্রয়োজন হয় সে অনুযায়ী ট্রাক না আসার কারণে দেশের সব জায়গায় চাহিদা অনুযায়ী কাঁচামাল সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হচ্ছে।

শুধু তাই নয়, সঠিক সময়ে বন্দর থেকে কাঁচামাল খালাস করতে না পারার কারণে আমাদের ড্যামারেজ গুণতে হয়। এই ড্যামারেজগুলো পে করতে হয় ডলারে। এখানে আমাদের দুইটা ধাপে ড্যামারেজ গুনতে হচ্ছে। একটা হলো- শিপিং ড্যামারেজ এবং অন্যটি হলো পোর্ট ড্যামারেজ। যেহেতু আমাদের পোর্ট মাল খালাসের জন্য ৩দিনের বেশি সময় দেয়না, পরিববহনের অভাবে জেডি থেকে ডিপোতে আনতেই ৩-৪ দিন সময় লেগে যায়। এরপর থেকেই আমাদের ড্যামারেজ শুরু হয়ে যায়। ফলে সার্বিক খরচ বেড়ে যাওয়াতে এর প্রভাব পড়ছে দেশের অন্যতম বৃহৎ খাত পোল্ট্রির ওপর এবং সার্বিকভাবে জনগণের ওপর। বিশেষ করে পোল্ট্রি সেক্টরের জন্য মহাবিপদ সংকেত বলে আমি মনে করি।

এগ্রিনিউজ২৪.কম: একটু আগে বলেছিলেন ‘এক দেশে তিন নীতি’, বিষয়টি একটু খোলাসা করে বলবেন?

আরিফুল হক মনির: অবশ্যই। যেমন ধরুন, চট্টগ্রাম থেকে পণ্য সরবরাহ করতে মিরেরসরাই এবং দাউদকান্দিতে যে ওজন স্কেল বসানো হয়েছে সেখানে ট্রাকের ওজন এবং মালসহ সর্বোচ্চ ২২ মে.টন মেইনটেইন করতে হচ্ছে। কিন্তু যমুনা ব্রিজ পার হলেই শুধু মালের ওজনই ১৫মে.টন মেইনটেইন করতে হচ্ছে। আবার এই দুইটা পয়েন্ট বাদে দেশের যেকোনো জায়গা থেকে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে ২০-২২-২৫ মে.টন কোনো ব্যাপার না। আপনি যতখুশি মাল আনতে পারবেন, কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

আমাদের দেশে আরো একটা বন্দর আছে সেটা হলো নারায়ণগঞ্জ এর পাগলা এবং কাঁচপুর বন্দর। এই বন্দর দিয়েও প্রচুর কাঁচামাল আমদানি হয়। যেমন-কয়লা, ভুট্টা, সয়াবিন, র‌্যাপসিট, বিআরবি, গম, স্ক্রাব, সিমেন্টের ক্লিংকার, টাইলস এর ফøাইসসহ আরো অনেক কাঁচামাল।

গাড়িগুলো যেহেতু চট্টগ্রাম গেলে ১২-১৩ মে.টনের বেশি মাল আনতে পারে ন্ াএবং সেখানে তাদের আপডাউনে দুইদিন সময় লেগে যায়। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জ গেলে স্বল্প দুরত্বে কম সময়ে বেশি টাকা আয় করা যায়। সেক্ষেত্রে ট্রাকচালকদের চট্টগ্রামে পোষায় না বিধায় তারা সেখানে যেতে চায় না। আর এই সংকট গিয়ে প্রভাব ফেলে চট্টগ্রাম বন্দরে। যেখানে প্রতিদিন পণ্য সরবরাহে গাড়ি লাগে ৩ হাজারটা, সেখানে গাড়ি পাওয়া যায় মাত্র ৫শ’ থেকে ১ হাজারটা। এতে করে আমাদের সরবরাহ ব্যবস্থা যেমন বিঘিœত হচ্ছে তেমনি খরচও বেড়ে যাচ্ছে দ্বিগুন। আগে যেমন চট্টগ্রাম থেকে পণ্য সরবরাহতে কেজিপ্রতি খরচ পড়তো ১টাকা, বর্তমানে সেটি পড়ে ২টাকা। আবার যমুনার সাইড থেকে আনতে খরচ হচ্ছে ৩ টাকা।

তাছাড়া আরো একটি বিষয় হলো, বাংলাদেশে বর্তমানে বড় বড় শিল্প গ্রুপ ফিড ব্যবসায় আসছে এবং তাদের অনেকেই নিত্যপ্রয়োজনীয় কাঁচামাল সরবরাহের ব্যবসা করেন। সুতরাং, তাদের যখন মাল আমদানি হয় তখন উনাদের প্রতিদিন গাড়ি লাগে ৫শ’ থেকে হাজারটি। ওই সময় উনারা যখন মার্কেট থেকে গাড়িগুলো টান দেয় তখন গাড়ির চাহিদা বেড়ে যায়, ভাড়া হয়ে যায় দুই থেকে তিনগুণ। তখন আমার কাছে মনে হয়, ফিডমিলের কাঁচামালের ব্যবসা ছেড়ে পরিবহন ব্যবসা শুরু করি।

এগ্রিনিউজ২৪.কম: সামনের দিনগুলোতে এ সংকট আরো বাড়বে বলে কী মনে করেন?

আরিফুল হক মনির: সামনে রমজান আসছে। রমজান মাসে সবকিছুর চাহিদা বেড়ে যায়। আবার এ সময় আরো কিছু নতুন পণ্য যোগ হয়। ছোলা, ডাল, খেজুর ইত্যাদি। তখন তো গাড়ি সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠে। আবার পোল্ট্রি সেক্টরের পিক আওয়ার হচ্ছে মার্চ থেকে আগস্ট মাস। যেহেতু আমাদের পোল্ট্রি সেক্টরের প্রায় ৯০% কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় আর এই মালগুলোর বেশিরভাগই আসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে তাই, রমজানের আগেই যদি এই সমস্যার সমাধান করা না যায় তাহলে ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়তে হবে।

রমজান মাসে মুরগির চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। আবার মুরগির চাহিদা বেড়ে গেলে ফিডের চাহিদা বেড়ে যায়। তখন আমাদের কাঁচামালের চাহিদাও বেড়ে যায়। কারণ, একটার সাথে আরেকটা নিবিড়ভাবে জড়িত। আবার ফিড উৎপাদনের পর সেগুলো সরবরাহ করতে হবে। কাঁচামাল আনলাম, ফিড উৎপাদন করলাম কিন্তু কিন্তু সঠিক সময়ে পণ্যগুলো সরবরাহ করতে পারলাম না, তাহলে তো কোনো লাভ নেই। আর এক্ষেত্রে আমাদেরকে বিশাল একটা ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। তখন মধ্যসত্বভোগীরা লাভবান হয়। যেমন- এক জায়গায় মুরগির দাম থাকে ১৮০ টাকা, আরেক জায়গায় থাকে ১২০ টাকা এবং কোনো কোনো জায়গায় ২০০টাকাও হয়ে যায়।

এগ্রিনিউজ২৪.কম: এই সমস্যাগুলো কী আপনাদের সংশ্লিষ্ট এসোসিয়েশনের নজরে এসেছে এবং তারা কোন পদক্ষেপ নিয়েছেন?

আরিফুল হক মনির: ব্যাক্তিগতভাবে এসোসিয়েশন সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের সাথে আমি আলাপ করেছি। আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি নিয়ে তেমন কিছু হয়েছে বলে আমার জানা নেই। যেহেতু সামনে রজমান আসছে, সেহেতু সবার সাথে আলোচনা করার জন্য খুব দ্রুতই বসবো ভাবছি। কারণ, সমস্যা আমার একার না। এটা সংশ্লিষ্ট সব ব্যবসায়ীদের একটা বিরাট সমস্যা।

এগ্রিনিউজ২৪.কম: ব্যাক্তিগতভাবে এই সমস্যা সমাধানে কি কি উপায় আছে বলে আপনি মনে করেন?

আরিফুল হক মনির: এক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে -যেহেতু এই সমস্যাটা একটা জাতীয় পর্যায়ে চলে গেছে, সেহেতু আমাদের যতগুলো সংগঠন এবং এজেন্সি আছে সবার সাথে সম্মিলিতভাবে বৈঠক করতে হবে। সবাইকে এক হতে হবে। এখানে আবার শুধু সংগঠনগুলোকে বসলে হবে না, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং সরকারের এজেন্সিগুলোর সাথেও আমাদের আলোচনা করে সমাধানের উপায় বের করতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে আমরা সবাই ভয়াবহ সমস্যার সম্মুখীন হবো।

এগ্রিনিউজ২৪.কম: মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

আরিফুল হক মনির: আপনাকেও ধন্যবাদ।

This post has already been read 14775 times!