Tuesday 19th of March 2024
Home / প্রাণিসম্পদ / গবাদিপশুর থাইলেরিয়াসিস রোগের কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

গবাদিপশুর থাইলেরিয়াসিস রোগের কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

Published at জুন ৯, ২০১৯

ডা. এ এইচ এম সাইদুল হক : থাইলেরিয়াসিস গবাদিপশুর রক্তবাহিত এক প্রকার প্রোটোজোয়াজনিত রোগ। এ জীবাণু গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়াকে আক্রান্ত করে। সাধারণত গ্রীষ্মকালে থাইলেরিয়াসিস রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়। থাইলেরিয়ার জীবাণু আক্রান্ত গরু থেকে সুস্থ গরুতে আঠালির মাধ্যমে এ রোগ সংক্রমিত হয়ে থাকে। গ্রীষ্মকালে আঠালির প্রজনন ও বংশবৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত সময়। এ কারণে গ্রীষ্মকালে গরু আঠালি দ্বারা বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে এবং দ্রুত রোগ ছড়াতে সাহায্য করে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে থাইলেরিয়াসিস দেখা যায়। থাইলেরিয়া (Theileria) গণভুক্ত বিভিন্ন প্রজাতির প্রোটোজোয়া দ্বারা এ রোগ সৃষ্টি হয়ে থাকে। এ রোগের ক্লিনিক্যাল লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পর পশুর রক্তের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা খুব নিচে নেমে যায়। ফলে রোগটি নির্ণিত হওয়ার পর চিকিৎসা দিলেও গরুকে সুস্থ করে তোলা প্রায়ই সম্ভব হয় না। তাছাড়া মাঠপর্যায়ে গরুর রক্ত পরিবহন বাস্তবে সম্ভব হয়ে উঠে না। এ রোগের চিকিৎসার জন্য উন্নতমানের ওষুধের দাম খুব বেশি এবং তা সর্বত্র সহজে সব সময় পাওয়া যায় না। এ কারণে থাইলেরিয়াসিস অর্থনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ রোগ সংকর জাতের গরুতে বেশি দেখা যায়। সংকর জাতের একটি গাভীর দাম ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা। গবাদিপশুর খামারের ক্ষতিকর রোগগুলোর মধ্যে থাইলেরিয়াসিস একটি অন্যতম রোগ। আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি জেলাতেই এ রোগ দেখা যায়। থাইলেরিয়া রোগে প্রতিবছর বাংলাদেশে কোটি কোটি টাকা মূল্যের গো সম্পদ নষ্ট হয়ে থাকে।

এপিডেমিওলজী : আফ্রিকা ও এশিয়ায় গবাদিপশুর এ রোগ হয়। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে গবাদিপশুর ক্লিনিক্যাল রোগ হয়। বাংলাদেশে শতকরা ৮.৪৪ ভাগ গরুর রক্তে এ রোগের প্রোটোজোয়া চিহ্নিত হয়েছে। সব বয়সের বিদেশি জাতের গরু এবং তাদের সংকর জাত এবং দেশি বাছুরে এ রোগ হয়। চারটি সত্ত্বা যথা পোষক, পরিবেশ, পরজীবী এবং ভেক্টর -এর উপস্থিতিতে এ রোগের বিস্তার বৃদ্ধি পায়। গরমের কারণে সৃষ্ট ধকল, পরিবহন, সমসাময়িক রোগ (inter current disease), টিকাদান কর্মসূচি রোগের তীব্রতায় অবদান রাখে। এছাড়া দেশি জাতের প্রাপ্ত বয়স্ক গরুর ক্লিনিক্যাল রোগ হয় না তবে এ প্রেটোজোয়ার বাহক হিসেবে কাজ করে। বছরের সব ঋতুতে বিচ্ছিন্নভাবে এ রোগ হতে পারে তবে প্রধানত গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে (মে থেকে অক্টোবর) এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয়। প্রধানত আক্রান্ত আঠালির (Hyalomma anatolicum anatolicum) দংশনের মাধ্যমে এ রোগ সংক্রমিত হয়। নিম্ফ থেকে পূর্ণাঙ্গ আটালি এ রোগ ছড়াতে সক্ষম।

রোগের লক্ষণ : গরুর প্রবল জ্বর (১০৪-১০৭ ডিগ্রী ফারেনহাইট), ক্ষুধামন্দা, রক্তশূন্যতা, চোখ দিয়ে পানি পড়া, রুমেনের গতি হ্রাস, শরীরের বিভিন্ন অংশের লসিকাগ্রন্থি ফুলে যাওয়া; বিশেষ করে কানের, ঘাড়ের ও চামড়ার নিচের লসিকাগ্রন্থি ফুলে যায়, রক্ত ও আমমিশ্রিত ডায়রিয়া ও নাসিকা থেকে শ্লেষ্মা নির্গত হয়। এ সময় গরুর রুচি খামখেয়ালীপূর্ণ (দানাদার খাদ্যের প্রতি অনীহা) হয় এবং রুমেনের গতি ও দুধ উৎপাদন হ্রাস পায়। গরুর বাইরের লিম্ফনোডগুলো স্ফীত হয়ে যায়, ক্ষেত্রবিশেষে নারিকেলসদৃশ আকার ধারণ করতে পারে। এ সময় গরু শুকিয়ে যায় এবং কোনো এন্টিবায়োটিক দ্বারা চিকিৎসায় ফল পাওয়া যায় না। দুধ উৎপাদন কমে যায়, হাঁপায় এবং ধীরে ধীরে গরুর মৃত্যু ঘটে। জীবাণু দ্বারা রক্তের লোহিত কণিকা আক্রান্ত হওয়ায় রক্তস্বল্পতা, হেমোগ্লোবিনিউরিয়া ও জন্ডিস দেখা দেয়। মৃত্যুর পূর্বে হঠাৎ করে গরুর শরীরের তাপমাত্রা হ্রাস পায়। সাধারণত আক্রান্ত হবার ১৮-২৪ দিন পর গরু মারা যায়। এ রোগে অনেক ক্ষেত্রে আক্রান্ত কোষ দ্বারা মস্তিষ্কের ক্যাপিলারি অবরুদ্ধ হয়ে যায় ফলে অস্বাভাবিক চলনভঙ্গি ও শক্ত বস্তুতে মাথা চেপে ধরতে (Turning sickness) দেখা যায়। মৃত্যুর পূর্বে পশু সাধারণত শুয়ে পড়ে, তাপমাত্রা কমে যায় এবং ফুসফুসে পানি জমার কারণে মারাত্মক শ্বাসকষ্টে ভুগতে দেখা যায়। এ সময় নাক দিয়ে ফেনাযুক্ত তরল পদার্থ নির্গত হতে দেখা যায়। মূত্রে বিলুরুবিন থাকায় এর রঙ গাঢ় বাদামি থাকে।

পোস্টমর্টেম লক্ষণ ১.  এ রোগে আক্রান্ত গবাদিপশুর পোস্টমর্টেম পরীক্ষায় রোগের বিষয়ে আরো নিশ্চিত হওয়া যেতে পারে। পোস্টমর্টেমে যে সব লক্ষণ পরিলক্ষিত হয় তা হলো-

১.  শরীরের বিভিন্ন জায়গায় স্ফীত লিম্ফনোড থাকে যা ইডেমা ও হিমোরেজ যুক্ত।

২. প্লীহা স্ফীত ও এতে রক্তক্ষরণ (Haemorrhage) থাকে।

৩. সেরাস ও মিউকাস মেমব্রেনে রক্তক্ষরণ থাকে।

৪. যকৃত স্ফীত, হলুদাভ এবং এতে বিন্দু বিন্দু দাগ থাকে।

৫. এবোমেসামের মিউকোসায় আলসার থাকে এবং এর চারপাশে হিমোরেজিক জোন থাকে।

This post has already been read 7340 times!