Thursday 18th of April 2024
Home / মতামত / কোভিড-১৯: হাত ধোয়া ও প্রান্তিক নারী

কোভিড-১৯: হাত ধোয়া ও প্রান্তিক নারী

Published at অক্টোবর ১৫, ২০২০

প্রতীকি ছবি

আশরাফী বিন্তে আকরাম মোছা. সুরাইয়া আক্তার : সারাবিশ্বে ১৩তম বারের মতো আজ  “গ্লোবাল হ্যান্ড ওয়াশিং ডে” বা “বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস”  পালিত হচ্ছে। ২০০৮ সালে সুইডেনের স্টকহোমে যখন সর্বপ্রথম ১৫ অক্টোবর হাত ধোয়া দিবসটি পালন করা হয় সেইসময় জাতিসংঘের আহ্বানে বাংলাদেশেও দিবসটির সূচনা হয়। এ দিবসের মূল লক্ষ্য হল,সব দেশের মানুষকে  পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার আওতায় নিয়ে আসা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

মহামারী করোনার জন্য অন্যান্য বছরগুলোর চেয়ে এবছরের হাতধোয়া কার্যক্রম আমাদের কাছে বিশেষ  অর্থবহ । কেননা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০-৩০ সেকেন্ড ধরে  জীবানুনাশক সাবান ও নিরাপদ পানি  দিয়ে ঘন ঘন হাত ধোয়াকে  কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে অন্যতম কার্যকরী পদক্ষেপ হিসেবে ঘোষণা করেছে। কিন্তু নারী-পুরুষ ও শিশু নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষেরা কি  হাত ধোয়ায় সমান অংশীদারিত্বের সুযোগ পায়?

আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোয় যেকোন শ্রেণির জন্যে গৃহকর্মে  জেন্ডার সুনির্দিষ্ট ভূমিকা  যেমন∶সন্তান লালন-পালন, রান্না-বান্নার মত দায়িত্ব নারীর উপর বর্তায়। তাই দৈনন্দিন কাজকর্মে মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত  নারীদের মতই পরিবারের এবং নিজের সুস্থতার জন্য বস্তিতে বসবাসরত নি¤œবিত্ত নারীদেরকেও হাত ধোয়ার মত কার্যকর অভ্যাসটির অনুশীলন করতে হয়। কিন্তু  যেখানে স্বাভাবিক সময়ে  পানির অপর্যাপ্ততা এবং  একাধিক সাবানের ব্যবহার  নিশ্চিত হয়না সেখানে এই মহামারী সময়ে বস্তির ঐ নারীটি কিভাবে ঘন ঘন হাত ধুয়ে তার পরিবারের স্বাস্থ্য সুরক্ষায়  ভুমিকা পালন করছে?

সাধারণত, একজন নারীকে খাবার তৈরি ও পরিবেশনের আগে, খাওয়ার আগে ও শেষে, শৌচকর্মের  পরে,ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারের পর, বাইরের পশু-প্রাণি বা গৃহপালিত পশু-পাখি ধরার পর, হাত দিয়ে নাক ঝাড়ার পরে,শিশুকে টয়লেট ব্যবহারে সহযোগিতা করার পরে এবং  যখন হাত নোংরা বলে মনে হবে তখন ভালো করে হাত ধুয়ে নিতে হয়। কিন্তু বর্তমানে মহামারী মোকাবেলায় সর্বক্ষেত্রে সবকাজেই হাত ধোয়ার ব্যাপকতা বেড়েছে। তাই জীবাণুনাশক  সাবানের ব্যবহারও বেড়েছে পূর্বের তুলনায় কয়েকগুণ । একজন নারীকে থালাবাসন ধোয়া, গোসল করা, কাপড় পরিষ্কার করা, টয়লেটের পর, মাসের বিশেষ দিনগুলোতে এমনকি খাবার পরিবেশন ও খাওয়ার আগে আলাদা আলাদা সাবানের ব্যবহার  নিশ্চিত করতে হবে। নতুবা হাত ধোয়ার উপকারিতা সে পাবেনা। কিন্তু  বস্তির একটি সীমিত আয়ের পরিবারে একজন নারীর জন্যে প্রতিটি স্তরে আলাদা সাবান ব্যবহার কি নিশ্চিত হয়?  আমাদের নিজস্ব গবেষণায় তথ্য সংগ্রহকালে বস্তিবাসীর অনেকের সাথে কথোপকথন থেকে আমরা জানতে পারি ৫থেকে ৬ জনের একটি পরিবারে ব্যক্তিগত সুরক্ষায় সাবান কিনতে তাদের মাসে প্রায় ৩০০-৩৫০ টাকা খরচ হয়। সেইক্ষেত্রে বস্তির এই  নারীরা  অধিকাংশই সন্তান ও নিজের  শৌচকর্মের পর সাবানের পরিবর্তে ছাই এবং খাবারের আগে গোসল করার সাবান আবার অনেক ক্ষেত্রে কেবল পানি দিয়ে হাত ধুয়ে নেয়।

ইউনিসেফের মতে, সাবান ও পানি না পাওয়া গেলে ক্লোরিনযুক্ত পানি অথবা অন্তত ৬০ শতাংশ অ্যালকোহলসমৃদ্ধ হ্যান্ড স্যানিটাইজার সবচেয়ে ভালো বিকল্প। এগুলোও না পাওয়া গেলে সাবান মিশ্রিত পানি বা ছাই ব্যবহার করা যেতে পারে, যদিও তার কার্যকারিতার মাত্রা কম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ন্যাশনাল হাইজেনিস সার্ভে-২০১৯ প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে যে খাবার গ্রহণ করার আগে দেশের মাত্র ৪০ ভাগ মানুষ  সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে থাকে। খাবার তৈরি ও পরিবেশনের আগে হাত ধুতে মাত্র ৩৬ ভাগ মানুষ সাবান ব্যবহার করছে।  মলত্যাগের পর হাত ধোয়ায় সাবান ব্যবহার করছে ৫৫ ভাগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফের অনুমান হলো, পৃথিবীর  প্রায় ৩০০ কোটি লোকের বাড়িতে সাবান এবং পানি কোনটাই নেই (বিবিসি নিউজ বাংলা, ২ মে, ২০২০)। তাছাড়া করোনার মত গ্লোবাল ভাইরাস মোকাবেলায় একদিকে যেমন ঘন ঘন জীবাণুনাশক সাবান দিয়ে  হাত ধোয়ার প্রচারণা করা  হয়েছে বা হচ্ছে, তেমনি  বাজারে  বিভিন্ন ব্র্যান্ডের জীবাণুনাশক সাবানের দাম প্রতি পিসে ১-২ টাকা করে বেড়েছে। ফলে দাম, চাহিদা আর যোগানের অসামঞ্জস্যতা প্রান্তিক নারীদের হাত ধোয়ার মত অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর, রোগ প্রতিরোধে সবচেয়ে  সহজ  ও কার্যকর ব্যবস্থায় সমান অংশীদারিত্ব নিশ্চিত হচ্ছেনা ।

অন্যদিকে, হাত ধোয়ার জন্য প্রয়োজন নিরাপদ পানি। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে হাত ধোয়ার নিরাপদ পানিতো পরের কথা, পান করার জন্য নিরাপদ পানি পাওয়াটাই অনেক দুষ্কর হয়ে দাঁড়ায়। ওয়াসার পানি,  কনটেইনারের পানি, জারের পানি, বিভিন্ন কো¤পানির পরিশোধিত পানি যখন আমাদের হাতে আসে তখন তা কতটুকু নিরাপদ থাকে? ৪২ শতাংশ বাসাবাড়ির পানিতে রোগজীবাণুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে যা পরিমাণে অনেক বেশি (প্রথম আলো, ২০১৯)। এ অবস্থায় হাত ধোয়ার নিরাপদ পানি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কিন্তু কোভিড-১৯ প্রতিরোধে  সংরক্ষিত পানির  চেয়ে কল থেকে পড়ন্ত পরিষ্কার পানিতে হাত ভেজানোকে উত্তম বলে মনে করা হয়। কারণ পানি সংরক্ষণে সতর্ক না হলে  বালতি বা পাত্রে রাখা পানি পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত নাও হতে পারে (www.cdc.gov)।

বাংলাদেশের  বস্তি এলাকাগুলোতে দেখা যায়, পরিবারগুলোর অধিকাংশই পানির জন্য একটি মাত্র উৎস শেয়ার করছে। ফলে পানি তাদের সংরক্ষণ করে রাখতেই হয়। বস্তি শুমারি ও ভাসমান লোক গণনা, ২০১৪ অনুযায়ী বস্তি এলাকায় ৪৩ দশমিক ৩ শতাংশ  মানুষ পান করা  ছাড়া অন্যান্য কাজে ট্যাপের পানি ব্যবহার করে। ৪৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ  মানুষ সেইখানে দ্বিতীয় পানির উৎস হিসাবে নলকূপের পানি ব্যবহার করে। আমাদের এই পরিসংখ্যান জানান দেয়, বারবার হাত ধোয়ার জন্য পর্যাপ্ত পানি, কিংবা পানির  উৎসের সহজলভ্যতার সংকট নারীদের হাত ধোয়ার ক্ষেত্রে একটি বড় বাঁধা। এক্ষেত্রে ভবিষ্যতে কি হতে পারে তার পূর্বাভাসে  জাতিসংঘ বলছে, ২০৩০ সাল নাগাদ ৩৫টি দেশে পানি দুর্লভ হয়ে পড়বে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের রিপোর্ট মতে, ২০১২ সালে ১০০ কোটির বেশি মানুষ নিরাপদ পানির সংকটে ভুগেছিল। ২০ বছর পরে বাংলাদেশের ১০ কোটিসহ বিশ্বের কমপক্ষে ৪০০ কোটি মানুষ বিশুদ্ধ পানির সংকটে নিপতিত হবে (যুগান্তর, ১৫ অক্টোবর ২০১৯)।

ইউনিসেফ বর্তমান কোভিড-১৯ সংক্রমণ  প্রতিরোধে পাঁচ ধাপে হাত ধোয়া স¤পন্ন করার  পরামর্শ দিয়েছে। যার পঞ্চম ধাপটি হচ্ছে পরিষ্কার কাপড় বা শুধু এককভাবে ব্যবহার করা হয় এমন তোয়ালে দিয়ে হাত  মুছে নিতে হবে । ইউনিসেফ আরও বলে শুষ্ক ত্বকের চেয়ে ভেজা ত্বক থেকে জীবাণু সহজে ছড়ায়।  তাই অন্য কোথাও  জীবাণু ছড়ানোর আগে হাত পরিষ্কার কাপড়, টিস্যু বা ব্যক্তিগত ব্যবহার্য তোয়ালে দিয়ে মুছে শুকিয়ে নেওয়াই সর্বোত্তম।  কিন্তু বস্তির পারিবারিক যৌথ সংস্কৃতিতে একজন নারীর পক্ষে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের প্রতীকী ব্যবহার হিসাবে নিজস্ব গামছা, তোয়ালে কিংবা  টিস্যুর ব্যবস্থা করা  কি সম্ভব?

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ৬ এর প্রতিপাদ্য নিরাপদ পানি ও পয়োনিষ্কাশন যার আকর্ষণীয়  দিক  হলো  কাউকেই পেছনে ফেলে রাখা যাবে না অর্থাৎ এই লক্ষ্যমাত্রা সবার জন্য প্রযোজ্য হবে। কিন্তু বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছে।  তার প্রমাণ মিলে হাত ধোয়া এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রেও। হাত ধোয়ার জন্য যে উপকরণগুলো প্রয়োজন তা সহজলভ্য না হলে কখনই এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নয়। স্বাভাবিক সময়ে বস্তির প্রান্তিক নারীরা যেখানে  হাত ধোয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পানির সরবরাহটুকু পায়না তাহলে এই মহামারী কালে যখন পূর্বের তুলনায়  কয়েকগুণ বেশি হাত ধোয়ার কথা বলা হচ্ছে সেখানে তারা কতটুকু সুযোগ পাচ্ছে তা একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। তাই  লক্ষ্য স্থির করার সময় এটা কার জন্য করা হচ্ছে, বাস্তবে এটা কতটুকু উপযোগী ইত্যাদি বিষয় ভেবে দেখা জরুরি ।

যে নারীর হাতে পারিবারিক সুস্থতা অনেকাংশে নির্ভর করে হোক সে ধনী,মধ্যবিত্ত কিংবা দরিদ্র শ্রেণির তার সুরক্ষা আমাদের সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে। তাই ২০২০ সালে ১৫ অক্টোবর আমাদের জন্য নতুন বার্তা নিয়ে আসুক। সেই বার্তায় ব্যবস্থা থাকুক হাত ধোয়ার মত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অথচ সাধারণ বিষয়ে সকল নারীর সমান অংশীদারিত্বের। প্রয়োজনে সাবানের মত নিত্য ব্যবহার্য পণ্যগুলো এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন সাপেক্ষে ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখতে হবে সরকারকে । তবেই না  ১৫ অক্টোবর  হবে একটি জীবনমুখী কার্যকর দিবস।

লেখক: ১. সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, হাজী মোহাম্মাদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর। ২. শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, হাজী মোহাম্মাদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর।

This post has already been read 3093 times!