Friday 29th of March 2024
Home / পোলট্রি / আন্ডা নিয়ে যত আন্ধাবাজি

আন্ডা নিয়ে যত আন্ধাবাজি

Published at নভেম্বর ২, ২০১৯

[মো. খোরশেদ আলম জুয়েল]

আন্ধাবাজি-১:
তখন আমি ক্লাশ এইটে পড়ি। আমার নানী আসছেন বাসায়। স্কুল সাময়িক পরীক্ষা চলছিল। দুপুরের পর পরীক্ষা। লাঞ্চ করে পরীক্ষা দিতে যাবো এবং মেন্যুতে  সেদিন ছিল ডিম। খাওয়া কেবল শুরু করছিলাম অমনি হঠাৎ আমার নানী এসে মা’কে বললেন, ‘করোস কী, করোস কী, আমার নাতিরে আন্ডা (ডিম) দিয়া ভাত খাইতে দিছোস ক্যালা? পরীক্ষা দিবার যাইবো, পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে আন্ডা খাইতে নাই। আমার নাতি যদি পরীক্ষায় আন্ডা পায়!

ছাত্রাবস্থায় খুব মেধাবী ছিলাম তা দাবী করবোনা, তবে একেবারে খারাপও ছিলামনা। তারপরও নানীর কথায় কেন জানি মনের ভেতর খটকা তৈরি হলো। যদি সত্যিই পরীক্ষা খারাপ হয়ে যায়।

নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়, ফার্মের মুরগির ডিম তেমনভাবে পরিচিত হয়েও উঠেনি সাধারণের কাছে তখন। ডিম বা মুরগির মাংস তখনো বেশিরভাগ মানুষের কাছে গৃহস্থলীতে পালিত মুরগির ওপরই নির্ভর ছিল। ডিম বা মুরগির মাংস ছিল মোটামুটি অবস্থাপন্ন বা জামাই কিংবা অতিথি আপ্যায়নের অন্যতম অনুষঙ্গ। খুব একটা ভালো লাগতো না, ডিম বা মুরগির মাংস ছিল পছন্দের তালিকার শীর্ষে। কী আর করা, নানীর কথা শুনে এক ধরনের খটকা লেগে গেল। সন্দেহ রোগ ভেতরে ঢুকলে যা হয় আর কী। এক প্রকার বাধ্য হয়েই ডিমের বদলে বাটারবান খেয়ে পরীক্ষা দিতে গেলাম। অথচ সে সময় জানতামনা যে, ডিমের কোলিন (choline) মস্তিষ্ক ও নার্ভের কার্যকলাপ সক্রিয় রাখে এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে পুষ্টি যাতায়াত ব্যবস্থাকে তরান্বিত করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। যে খাবারটি মস্তিষ্ক ভালো রাখতে সহায়তা করে সেটি পরীক্ষা খারাপ করতে সহায়তা করবে কীভাবে সেটিও জানা ছিলনা। সত্যি বলতে, জানার অভাবেই আমরা মানুষ যেকোনো কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হই।

এমনকি দেড় যুগ পরেও আজকের ডিজিটাল সময়ে এ রকম ধারনা রয়েছে অসংখ্য শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাঝে। সমাজে কিছু কিছু মিথ্ বিশ্বাস কিংবা কুসংস্কার রয়েছে যা এখনো দাপটের সাথে বিদ্যমান। পরীক্ষা দেওয়ার আগে ডিম  খাওয়া নিয়ে এমনই একটি মিথ বা কুসংস্কার যা যুগ যুগ ধরে প্রচলিত। যদিও ডিম খাওয়ার ফলেই পরীক্ষায় ফেইল করেছে এমন কোন বৈজ্ঞানিক কিংবা ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ নিজেও পাইনি, কেউ পেয়েছেন বলেও শুনিনি।

হয়তো অনেকে মনে মনে হাসছেন।  কারণ বাংলাদেশে এমন ছাত্র-ছাত্রীই পাওয়া রীতিমতো দুষ্কর যারা অন্তত ছাত্র জীবনে পরীক্ষার আগে ডিম খাওয়া নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে না ভোগেন। শিক্ষিত অশিক্ষিত সব ধরনের মানুষের ভেতর কিছু কুসংস্কার ছিল, আছে এবং থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত বিষয়টি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করা না যায়। তবে আশার কথা হলো পোলট্রি শিল্প সংশ্লিষ্টদের ডিম সম্পর্কে ইতিবাচক তথ্য উপাত্ত প্রচারনার কারণে ডিম সম্পর্কে মানুষের নেতিবাচক ধারনা আস্তে আস্তে দূর হচ্ছে। তবে কুসংস্কার আস্তে আস্তে দূর হলেও কুপ্রচারনা একেবারে থেমে গেছে সেটি বলা যাবেনা।

আন্ধাবাজি-২:
ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে মাঝেমধ্যেই আরো একটি ভ্রান্ত ধারনা ছড়িয়ে পড়েছে মানুষের মাঝে এবং সেটি হলো প্লাস্টিক বা নকল ডিম। অনেক বড় বড় শিক্ষিত লোককেও দেখেছি বিষয়টি নিয়ে ভালোভাবে খোজ খবর না নিয়েই নেতিবাচক লেখালেখি করতে, অতি উৎসাহী হয়ে প্রচারনা চালাতে।

হঠাৎ করে একদিন দেশের শীর্ষস্থানীয় বিদ্যাপীঠের পরিচয় দিয়ে এক ভদ্র মহিলা এবং সাথে করে সাংবাদিকতায় পেশায় মোটামুটি পরিচিত এক মুখকে নিয়ে আসলেন আমার সাবেক কর্মস্থলে। সাথে ভিডিও ক্যামেরাও ছিল। ভদ্র মহিলা নাকি বাজার থেকে যে ডিম কিনেছেন সেগুলো নাকি নকল এবং তারই প্রমান নিয়ে এসেছেন আমাদের কাছে। বিষয়টি সম্পর্কে আমারও কৌতুহল ছিল তাই অফিসের দু’জন পোলট্রি এক্সপার্ট এবং আমি বসলাম তাদের সাথে বিষয়টি জানা ও বোঝার জন্য। কারণ ডিমের বিষয়গুলো এতটাই টেকনিক্যাল যে, আমারও ভালো করে জানা দরকার। তাছাড়া নকল ডিম যদি সত্যিই থেকে থাকে সেটি একজন ভোক্তা হিসেবে আমার জন্যও উদ্বেগের। কারণ, টাকা কামাই করে সেই টাকা দিয়ে আমিও ডিম কিনে খাই।

ভদ্রমহিলা খুব জোর দিয়ে বলেই চলেছেন যে, তার নিয়ে আসা ডিমগুলো নকল। আমাদের দুজন এক্সপার্ট ভিডিও ক্যামেরার সামনেই সম্ভব্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করলেন। তারা এক সময় সায় দিলেন ডিমগুলো আসলে নস্ট, নকল নয়। আমি বললাম, আপু নস্ট ডিম বা বায়োলজিক্যাল ডিফেক্টেড ডিমকে নকল ডিম বলছিনাতো সেটি দেখার বিষয় আছে। ভদ্রমহিলা এবার আরো জোর দিয়ে বললেন, ডিমগুলো নকল এবং আমাদের কাছে তথ্য-প্রমাণ আছে। সাথে রিপোর্টার সাহেব যোগ করলেন, জুয়েল ভাই আমরা এ রকম এক কারখানার সন্ধানও পেয়েছি। আমি উত্তর দিলাম, তাহলেতো ভাই ল্যাটা চুকে গেল। চলেন যাই ঐ ফ্যাক্টরিতে। ক্যামেরা নিয়ে আমিও যাবো এবং এ বিষয়ে রিপোর্ট ছাপাবো। তাছাড়া আপনারা যদি সত্যি নকল ডিমের ব্যবসায়ী বা উৎপাদকের সন্ধান পেয়ে থাকেন তবে র‌্যাব-পুলিশ-গোয়েন্দা নিয়ে সেখানে সরাসরি না যেয়ে এখানে আসছেন কেন? আসুন আমরা তাদের ধরিয়ে দিই।

এবার তারা কিছুটা চুপসে গেলেন। আমতা আমতা করে বলতে থাকলেন, না.. মানে ইয়ে.. আমরাও শুনেছি। আমি বললাম, শোনা কথা বা আন্দাজের ওপর ভিত্তি করে কোন ব্যাক্তি বা শিল্পের ওপর কী সরাসরি কালিমা লেপন করা যায়? এবার দুজনেই চুপ হয়ে থাকলেন। যাওয়ার আগে তাদেরকে বিনয়ের সাথে বললাম, যদি কখনো অথেনটিক সোর্স থেকে নকল ডিমের তথ্য বা প্রমাণ পান নিয়ে আসবেন। বিষয়টি নিয়ে আমারও প্রচন্ড আগ্রহ আছে। তবে হ্যা.. ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই’ এমন যেন না হয়।

আন্ধাবাজি-৩:
ডিম খেলে মোটা হয়ে যাবো, হৃদরোগ হবে, কোলেস্টরল বেড়ে যাবে এমন আন্ধা ধারনা করা লোকের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয় এদেশে। অথচ ডিমে বিদ্যমান কোলাইন হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। ডিমের মধ্যে এইচডিএল নামক যে কোলেস্টরল থাকে সেটি শরীরের জন্য উপকারী। এতে বিদ্যমান টাইপ-২ ডায়াবেটিস কমাতে সাহায্য করে। একজন মানুষকে সারাদিন কর্মদ্যোম রাখতে প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও মিনারেল থাকে একটি ডিমে। এতে বিদ্যমান রিবোফ্লাবিন কোষে শক্তি উৎপন্ন করতে সহায়তা করে, ফসফরাস স্বাস্থ্যকর হাড় ও দাঁত ছাড়াও সেল মেমব্রেন গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। যারা মনে করেন, ডিম খেলে মুটিয়ে যাবেন তাদের জন্য সুখবর হলো, মাত্র একটি ডিম দীর্ঘক্ষণ ক্ষুধা থেকে বিরত রাখতে পারে। তাই শরীরের জন্য অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণ করার প্রয়োজন পড়েনা। সুতরাং ক্ষুধা কম, মুটিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিও কম।

তবে আসল কথা হলো, সবকিছুই খেতে হবে পরিমিত। অতি খাওয়া যেমন ভালো নয় তেমনি অতি সাবধানতা সুখকর নয়। কখনো কখনো সাবধান হতে হতে আমরা কেউ কেউ এতটাই সাবধান হয়ে যাই যে, সেই সময় নিজের সাধারণ জ্ঞানটুকুও কাজ করেনা।

আন্ধাবাজি-৪:
ডিম খাওয়া নিয়ে শুধু সন্দেহ নয়, মানুষের মতো এখানেও বর্ণ বৈষম্য বিদ্যমান। এক্ষেত্রেও এক ধরনের আন্ধাবাজি কাজ করে আমাদের। অনেকের ধারনা সাদা ডিম অপেক্ষা বাদামি ডিম বেশি পুষ্টিকর। কিন্তু ধারনাটি সম্পূর্ণ ভুল। সাদা কিংবা কালো চামড়া দিয়ে যেমন মানুষের গুণ বিবেচনা করা যায়না তেমনি ডিমের রঙের ওপর এর গুণাগুণ নির্ভর করেনা। পার্থক্য শুধু সাদা পালকওয়ালা মুরগী সাদা ডিম পাড়ে, লাল পালকওয়ালা মুরগী লাল ডিম। প্রতিদিন একটি করে ডিম খাওয়া শরীরের জন্য কোন সমস্যাতো নয়-ই বরং শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পাওয়া যায় এখান থেকে। তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ডাক্টারি পরামর্শ আবশ্যক। আট দশ টাকার একটি ডিমে আপনি যে মানের প্রোটিন পাবেন অন্য কোন খাবারেই এত অল্প খরচে পাবেন না।

শুরু করেছিলাম নিজের বাস্তব জীবনের ঘটনা দিয়ে। এ কথা অনস্বীকারয যে, ডিম সম্পর্কে এখনো আমাদের সমাজে নানা ধরনের নেতিবাচক ধারনা এবং কুসংস্কার রয়েছে। এসব নেতিবাচক ধারনা ও কুসংস্কার দূর করার জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও এক্ষেত্রে বিশাল দায়িত্ব রয়েছে। আশার কথা হলো, পোলট্রি শিল্প সমন্বয় কমিটি এ ধরনের বিশেষ কিছু উদ্যোগও গ্রহণ করেছেন। তবে একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে- মানুষকে বোঝাতে হবে তথ্য এবং যুক্তি দিয়ে, গালাগালি কিংবা হেয়প্রতিপন্ন করে নয়। ডিম নিয়ে আন্ধাবাজি দূর হোক, সকল কুসংস্কার মুক্ত বাংলাদেশ হোক।

This post has already been read 6700 times!